লিখেছেনঃ নিঝুম মজুমদার
নাম ও ছবি সহ ৩২ জন ব্যাক্তির ৩২ টা পোস্টার দেখতে পেলাম। এই ৩২ জনকে গুজব রটনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে “ধরিয়ে দিন” জাতীয় পোস্টার প্রকাশিত হয়েছে সরকারী সেল থেকে।
প্রকাশও করেছেন আমাদেরই ভাই-ব্রাদার রা। তাঁরা সরকারী দলের প্রভাবশালী ব্যাক্তিবর্গ। ঘুমুতে যাবার আগে নিঃসন্দেহে ভয়ানক একটা সংবাদ।
এই ৩২ জনের নাম সহ আরো নামের পোস্টার যে করা হচ্ছে তা বলা বাহুল্য। এইসব পোস্টারের বাইরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছেও অনেকের নাম গোপনে গেছে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। সব কিছুই কানে আসে।
এদের নামে হয়ত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হবে, কিংবা পেনাল কোডের ১৫৩(ক) ব্যাবহৃত হবে কিংবা ৫৭ ধারা। গুটি কয়েক দলীয় ভৃত্য ছাড়া সারা দেশ এই সরকারের প্রতি ছি ছি করছে সেখানে ৩২ জনের পোস্টার বানিয়ে যে আতংক ছড়িয়ে দেয়া তাতে করে খুব একটা লাভ কি আদৌ হবে?
দিনাজপুরে বাতাবী লেবুর ব্যাপক ফলন কিংবা আমন ধানের বাম্পার ফলন ছাড়া যদি আর কোনো কথা বলা না যায় তাহলে সরকারের উচিৎ একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানিয়ে দেয়া। এতে করে এট লিস্ট একটা গাইড লাইনতো পাওয়া যাবে।
বিশ্বখ্যাত পন্ডিত নোয়াম চমস্কি তাঁর “ফেইল্ড স্টেটস্” গ্রন্থে ব্যার্থ রাষ্ট্রের একটা ধারনা দিতে চেয়েছেন। তিনি অনেকগুলো পরিমাপকের সাথে বলেছেন যখন একটা দেশ নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আইন কিংবা আন্তর্জতিক আইনের উর্ধ্বে নিজেদের মনে করতে থাকে তখন সেই রাষ্ট্রযন্ত্র মনে করে যে কোনো ধরনের সহিংসতা বা আগ্রাসন করবার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। ইনফ্যাক্ট এটিকে তারা তাদের অধিকার বলে মনে করে।
উপরের এই প্যারা পড়বার পরপর আপনাদের মনে হতে পারে বাংলাদেশকে আমি “ফেইল্ড স্টেটস্” বলেছি কিনা। এই বিষয়ে আমার উত্তর হচ্ছে, হ্যা বলেছি।
বাংলাদেশ খুব স্পস্টভাবে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। এটি পাটিগণিত অংকের মত খুব কঠিন করে যে বুঝতে হবে কিংবা রকেট সায়েন্সের মত বুঝতে হবে, তা নয়। শুধু হাতে গুনে গুনে হিসেব করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে।
আইন এখন সরকারের কাছে “হা হা” রি একশনের মত ব্যাপার। এর অভ্যন্তরীন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা রীতিমত সরকারের কথায় ওঠে আর বসে। এক্সিকিউটিভের যে নিজস্ব চিন্তা করবার স্বাধীনতা কিংবা যে বোধ বা বিবেচনা তার কিছুই এখন এক্সিকিউটিভের হাতে নেই।
পার্লামেন্ট এখন কাজ করছে এক হাস্যকর পক্রিয়ায়। এর একটি পুতুল বিরোধীদল রয়েছে যেটির প্রধান সাবেক একনায়ক এরশাদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিরোধী দলের প্রধান আবার প্রধানমন্ত্রীর বেতনভূক কর্মচারী। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। মানে দাঁড়ায় গৃহপালিত হাড্ডি খাওয়া গবাদি পশুর মতন।
জুডিশিয়ারী তো কবেই গেছে গোল্লায়। এর প্রধানকে মেরে কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপে। বসিয়েছে সরকারী গুনগান গাওয়া এক তালিবাজকে। ফলে রাষ্ট্রের যে তিনটি পিলার, পার্লামেন্ট, জুডিশিয়ারী আর এক্সিকিউটিভ এগুলো সিম্পলী কাজ করছে একজনের কথায়। একজনের বাঁশীর সুরে। এদেরও উপরে রয়েছে ভারত। ইনফ্যাক্ট ভারতের প্রেসকিপশান ট্রিগার করছে প্রতিটি সিদ্ধান্তে। ভারত যাকে চাইবে, সরকার সে ই গঠন করবে।
এটিকে নিও ইন্ডিয়ান কলোনী বললে খুব বেশী ভুল হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য এদেরও উপরে রয়েছে মার্কিন সিদ্ধান্ত বা মার্কিন পলিসি। চায়না কে ট্রিট করবার খাতিরে এই অঞ্চলে অবশ্য ইন্ডিয়ান পলিসির উপর মার্কিনিরা কিছু করবে না। আপাতত মার্কিনিদের কাছে চায়না গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভারতীয় লাভ-ক্ষতি মার্কিনিরা ভারতের সিদ্ধান্তের হাতেই ছেড়ে রেখেছেন।
ফলে আমরা যে বুক ফুলিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র-ফ্রাষ্টের গল্প করি এর পুরোটাই আসলে নিজেকে স্বান্তনা দেয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বর্তমান সরকার যে বিধ্বংসী অবস্থায় চলে গেছে সেটা নিয়ে অতীতে অনেক কথা আমি বলেছি। অনেক বাক্য ব্যয় করেছি। কিন্তু আজকের এই ৩২ টি পোস্টার দেখে আমার বুকটা ভেঙ্গে গেছে।
এখানে পরিচিত ও অপরিচিত অনেক ব্যাক্তির ছবি দেখেছি যাদের ভেতর অনেকেই নিতান্তই ছাপোষা ব্যাক্তি। যারা সরকারী এই ইতরামী, সরকারী এই লুন্ঠন, সহিংসতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন।
দশকের পর দশক ধরে এই বাংলাদেশের রাস্তায় মানুষ মুড়ি আর মুরকির মত খুন হচ্ছে। পুরো পরিবহন সেক্টরটি ঘুনে ধরা এবং ভঙ্গুর। বছরের পর বছর লক্ষ লক্ষ পরিবার হারিয়েছেন তাঁদের সন্তান, সন্ততি, আত্নীয়-স্বজনদের।
আজকের যে আন্দোলন আপনারা দেখছেন সেটি একজন দিয়া কিংবা একজন আব্দুল করিমের শোকের মার্চের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নয়। এটি দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ আর কষ্টের অতি সাধারন বহিঃপ্রকাশ।
পৃথিবীর সবচাইতে ভঙ্গুর দেশটিও এরকম পরিস্থিতিতে বাধ্য করত সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রীকে পদত্যাগ করাতে। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি করেনি। ইনফ্যাক্ট, করবার সামান্যতম আগ্রহও দেখায়নি।
কিন্তু জনতা যখন এই অনিয়মের বিরুদ্ধে দাবানলের মত ফুঁসে উঠলো ঠিক তখন সরকারী মন্ত্রী, এম পি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও নগন্য কর্মী পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে শ্ত্রু জ্ঞান করে রাস্তায় নেমে পড়লো।
আমরা বিষ্ময় নিয়ে দেখলাম সরকারী ছাত্র গুন্ডা বাহিনী আজকে রাজাকারদের মত করে কিংবা শান্তি কমিটির নেতাদের মত করে গুজব রটনাকারীদের লিস্ট বানাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতেই আমরা দেখলাম এই পোস্টার। হয়ত কাল আরো আসবে, তার পরদিন আরও।
খুব বেশী কিছু বলবার নেই আমার।
ইতিহাসের পাঠ আমার যতদূর পড়া রয়েছে এবং আমি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট যতদূর বিবেচনা করছি তাতে মনে হচ্ছে এই একনায়ক হয়ে ওঠে রাবণ সরকার নিশ্চিত পতনের দিকে একটু একটু করে এগুচ্ছে।
আজ দাবানল ছড়িয়ে গেছে একেবারে স্কুলের কিশোর পর্যায়ে। মানে দাঁড়াচ্ছে এই সরকারের অবস্থাটা ঠিক কোন যায়গা থেকে ঘৃণার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা নিজের চোখেই দেখা হয়ে গ্যালো।
ইতিহাসে কে টিকে যেতে পেরেছে এমন করে? বাতিস্তা, পিনোশে, ঈদি আমিন, টেইলর, সাদ্দাম, গাদ্দাফী, বেন আলী,কারিমভ, মুগাবে জিয়া, এরশাদ ?
কেউ পারেনি।
এই যে আজকে বিশ্বখ্যাত ফটো সাংবাদিক দৃক গ্যালারির শহীদুল সাহেবকে ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলো আল জাজিরাতে একটা বক্তব্য দিয়েছে দেখে, আপনাদের কি ধারনা এগুলো এমনি এমনি চলে যাবে?
যদি তা ভেবে থাকেন তবে ভুলের মধ্যে রয়েছেন। শহীদুল সাহেব ভেসে আসা লোক না। কালকেই সারা বিশ্ব কাভার করবে এই তথ্য। ইনফ্যাক্ট শুরু হয়ে গেছে।
বিশ্বের অনেক ফ্রী ল্যান্স সাংবাদিক, ইউটিউবার সকলেই বাংলাদেশ নিয়ে বলা শুরু করে দিয়েছে। এই দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।
যে তারুণ্যকে আজকে আওয়ামীলীগ শত্রু বানিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দিলো সেই তারুন্য-ই আপনাদের নামে আগামীকাল পোস্টার বানিয়ে ছড়াবে না কিংবা আপনাদের ধরিয়ে দিন বলে রাস্তায় নামবে না, এমন ভাবার কোনো কারন নেই।
সময় সব কিছুর উত্তর দিয়ে দেবে।