আমাদের জাতিগতভাবে অনেকগুলো সমস্যার কিছুকিছু অভ্যাস আমি ধরতে পেরেছি বিদেশে আসার পরে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে – আমাদের অধিকাংশ মানুষ ই বুঝিনা কখন -কোথায় থামতে হবে, খুব সম্ভবত ট্রাফিক লাইটে লালবাতি জ্বলে থাকার পর ও চলাচলের অভ্যাসটা আমরা সেভাবেই আত্বস্থ করেছি! আমি আগেও এনিয়ে বেশ কয়েকবার লিখেছি।
এর ফলে আমরা হয়তো আমাদের গন্তব্য পেছনে ফেলে চলে যাই, অনাকাঙ্খিত গন্তব্যে অথবা আমরা আদৌ আমাদের কাংখিত গন্তব্যে পৈছাতেই পারিনা – সুতরাং আমাদের সব কিছুতেই দারুন সব শুরুর পর ও আমরা নিজেরাই “নীল” ছাড়া বাংলাওয়াশ হয়ে ফ্যাকাশে রঙ নিয়ে ঘরে ফিরি! যেই পরীক্ষায় আমাদের লেটার মার্ক নিয়ে পাশ করার কথা, আমরা ৩২ পেয়ে ফেল করে বসে থাকি!!
হাজেরানে মজলিশ, স্কুল – কলেজের ভাই – বোন, বন্ধুবান্ধব, আত্বীয়স্বজন যারা এই লেখা পড়ছেন – শুধুমাত্র আমাদের দেশে চলমান নিরাপদ সড়ক আন্দোলন না, জাতিগতভাবে আমাদের অনেক কাজের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন এই চিত্রের সাথে, বিফলে লেখা ফেরত ( কমপক্ষে ৫ টা যুক্তিযুক্ত উদাহরণ দিবেন)।
আমি আগের লেখাতেই বলেছি, এই আন্দোলনকারীরা রাজপথে থেকে অথবা স্কুল কলেজে ফিরে গিয়ে যেভাবেই এমনতর যৌক্তিক দাবী করবে, আমি তাদের সেই মতামতের সাথে একমত পোষন করি ( যদিও আমার একমত থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না)। আমি এখনো সেই অবস্থানেই আছি – এই আন্দোলন আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে এবং হবে। তবে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি এখন এই আন্দোলনের একটা রুপরেখা টেনে আপাতত ক্লাসরুমে ফেরত যাওয়া দরকার।
যেমন সরকারকে ভিন্ন ভিন্ন দাবীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের সময় দেয়া যেতে পারে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে সেগুলো পূরণ না হলে আবার রাজপথে ফেরা যেতে পারে!
অন্ততঃ আমার সন্তানের বেলায় আমি তাই করতাম। যেমনটা বলেছিলাম আগের লেখায় যে এতে দাবীগুলো অতলে হারিয়ে যাওয়ার ও সুযোগ রয়েছে। যেহেতু আমরা “শিখছি” দাবী করছি, সেহেতু কিছুটা ভরসা পাওয়া যায় যে এগুলো পূরন হবে।
বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করে দেখুন, এই দাবীর হয়তো দুই একটা ছাড়া বাকীগুলোর সাথে অনেকগুলো পক্ষ জড়িত রয়েছে, তাই এগুলো পূরন করতে (অবশ্য যদি ইচ্ছা থাকে) লম্বা সময়ের প্রয়োজন। দাবীগুলো কাগজে লিখে ফটোকপি মেশিনের মতো কোন মেশিনে ঢুকিয়ে দিলেই, অন্যপ্রান্ত দিয়ে সমাধান বের হয়ে আসবে না। তাই এসব দাবি পূরণ না হওয়ার আশংকা থাকলেও সেই রিস্কটুকু আমাদের নিতে হবে, অন্তত আমাদের মতো দেশে! এছাড়া ঠিক এই মুহূর্তে আর কোন অপশন আছে কিনা, আমার জানা নেই।
এই ছাত্রছাত্রীরা সম্পুর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় গত চারদিন ছিল রাজপথে; সব রাজনৈতিক দলের শকুনেরাই ওত পেতে থেকেছে ২য় দিন থেকেই কিভাবে থাবা দিয়ে লাভের মাংস টুকু নিজের দিকে নেয়া যায় – সেই আশায়! অবশেষে ৫ম দিনে সবাই সফল হয়েছে। সারাদিন সব পক্ষের কর্মীরা, সাধারণ জনগণ যে যেভাবে পেরেছে গুজবে অংশ নিয়েছে। সব শিক্ষিত মানুষের দল আমরা, কোন রেফারেন্স ছাড়াই ইচ্ছামত নিজের মতামত দিয়ে গিয়েছি!!
ব্যাপারটা এমন নয় যে, বিটিভি শুধু দেশের বাতাবি লেবুর ফলনের খবর দিয়েছে বলে কোথাও কিছুই হয়নি! ছাত্রলীগ – ছাত্রদল- শিবির সবার সমান অংশদারীত্ব ছিল কালকের সকল অরাজকতায়। কেউ অরাজকতা করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর কেউ টিকে থাকার জন্য – এই যা পার্থক্য! অথচ যারা এই অরাজকতায় যারা সোচ্চার ছিল, কারো সন্তানই রাজপথে ছিলো না কাল, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
ছিল আমার – আপনার আপনজনেরাই।
শুধু আমাদের টক শো চালানো আর মাহফুজুর স্যারের গান গাওয়া প্রচারের যোগ্যতা সম্পন্ন চ্যানেল গুলোর মেরুদণ্ড একটু শক্ত থাকলেই অনেক সত্য ঘটনা দেখা যেতো; তেমনি কমানো যেতো অনেক গুলো সহিংসতা।
তবে প্রথমেই নৌমন্ত্রী কে অপসারণ করে, প্রধানমন্ত্রী টিভি তে এসে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে কিছু সত্য এবং দ্রুত সমাধান সম্ভব এমন দাবী মানার ও বাকীগুলো নির্ধারিত সময়ে মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিলে; আজ এই সমস্যা খুব সহজেই এড়ানো যেতো বলে আমার বিশ্বাস। কোটা আন্দোলন নিয়ে তার মন্তব্য এবং সেটা পরবর্তী তে পরিবর্তন করার ফলে, তার আশ্বাসে এবার আর কেউ আস্থা রাখতে পারেনি। আপনি অস্বীকার করলেও এটাই সত্যি। আর যে আগুন থেকে এতবড় অগ্নিকান্ডের শুরু, সে আগুনের সেই স্ফুলিঙ্গ পাশে রেখেই আপনি চাইলেই অগ্নিকান্ড নেভাতে পারবেন না!
যতই মিথ্যাচার আর গুজবের ভুল প্রমান দেয়া হোক না কেন, যতই বিরোধী দলের নেতাদের অডিও কথপোকথন ভাইরাল হোক না কেন; সেটা উস্কানি র দায়ে অভিযুক্ত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আর শাসকদল হিসাবে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ায় ব্যার্থ হওয়ায় এই ক্ষতির দায় সরকার অস্বীকার করতে পারেনা! এরকম গুজব (!) যে রটবে আগে থেকেই তো সেটা জানা ছিল, তো কোথায় আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা? কেন এগুলো অন্যভাবে প্রতিহত করার চেস্টা হলো না? বারবার নিজেদের হাতে রক্ত লাগার সুযোগ তো নিজেরাই করে দিচ্ছেন তারা, এখন গুজব গুজব করে আর কি লাভ? তাছাড়া কেউ মারা যায়নি – ধর্সিত হয়নি বলে তো আর যেসব ছাত্ররা আহত হয়েছে বা পুলিশের সাথে থেকে ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে, সেগুলো তো মিথ্যা নয়! চারিদিকে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে যে ভয়ের ছাপ, সেটা কি টের পায় এই দলের কেউ, সেটাই যে কতবড় পরাজয় – তা বোঝার মত মানুষ কি এই দলে এখন আর কেউ আছে? ছাত্রলীগের হাতে বিশ্বজিৎ এর রক্ত লেগে আছে, এবার তাদের হাতে লেগে গেল এই ছাত্রদের রক্ত!!
আওয়ামীলীগের জন্য দারুণ এক সুযোগ ছিল এই আন্দোলন, সাধারন মানুষের সাথে দুরত্ব কমিয়ে আনার কিন্তু তারা আবারো ব্যর্থ হয়েছে। আর মিথ্যার বেসাতিতে জন্ম দেয়া বিএনপি আর পাকিস্তানি গোলামদের জামাত তো প্রস্তুত ছিল ই এমন সুযোগের। মুল ঘটনার সাথে অনলাইনে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস দিয়ে ভীতিকর গুজব ছড়ানো তো এদের পুরানো ব্যবসা।
এই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুল লক্ষ্যই ছিল – অপরাধের বিরুদ্ধে চোখ খুলে দেয়া, অপরাধী যে ই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা! এই চারদিন তো সবাই খুব শিক্ষা নিয়েছি – লজ্জা পেয়েছি বলে বকবক করলাম, আসলে যে কি শিখেছি – সেটা গতকালই বোঝা হয়ে গিয়েছে।
কে কি বলবে জানিনা, তবে আজ থেকে আমি চাই না ছাত্রছাত্রী রা কেউ রাজপথে যাক। যেই আন্দোলন থামার কোন রুপরেখা নেই, মাথার উপর কোন ছাতা নেই, কোন নিরাপত্তা নেই, সেই আন্দোলনে অন্তত আমি আমার সন্তানকে যেতে দিতাম না। এই আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর যেই বক্তব্য তাদের ছিল, তারা বেশ ভাবেই সেটা করেছে – কারো সাহায্য ছাড়াই, জয় তাদের হয়েছেই। এখন দায়িত্ব আমাদের “বুইড়া প্রজন্মের”, তাদের সেই দেখানো পথে ঠিকঠাক ভাবে চলা..৷ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেই আশাটাও এখন ক্ষীনতর হয়ে গেল! বরাবরের মতো এবারো আমরা ঠিক সময়ে থামতে পারিনি, আবার ও সেই একই ভুল!
আমি চাই সব ছাত্রছাত্রীরা ঘরে ফিরে নিরাপদ থাকুক, তারা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকলে আবার কোন একদিন রাজপথ কাঁপাবে – সমাজের কোন না কোন ক্ষত সারিয়ে তুলতে।
লেখাটা শেষ করছি বাংলাদেশ দলের প্রাক্তন ফুটবল কোচ ডিডোর একটি মন্তব্য দিয়ে, মন্তব্য টা একদম সঠিক না হলেও মানে টা দাঁড়ায় , এই দেশের সবাই জানে সমস্যা কি, সবাই জানে সেই সমস্যার সমাধান কি, কিন্তু কেউই সেই সমস্যার সমাধান করেনা বা করতে রাজী না।
নতুন ভোর শুরু হোক আশার আলো সাথে নিয়ে…
ভালো থেকো আগামীর সাহসী প্রজন্ম, ভালো থেকো প্রিয় বাংলাদেশ….