গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থবিরতা বিরাজ করছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির গতি থেমে গেছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে গত দেড় বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বা ২০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২১ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। আর এ বছরের ১৫ নভেম্বর সেই রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১০১ কোটি (প্রায় ৩১ বিলিয়ন) ডলারে। যদিও গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে রিজার্ভ বাড়ছিল।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, শিগগিরই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও বাড়তে শুরু করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান জাগো বাংলা ২৪ ডট কমকে বলেন, ‘আমদানির চাপ থাকলেও সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও ভালো। ফলে রিজার্ভ আবারও রেকর্ড পরিমাণ বাড়তে পারে।’
অবশ্য বেশকিছু দিন ধরে আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে— এমন আশঙ্কা করছিলেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
আমদানির চাপ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে সম্প্রতি এক ডজন ব্যাংককে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই অপরাধে গত বছরের শেষ সময়ে ২৬ ব্যাংককে শোকজ করা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৪ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত কয়েক মাস ধরে আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) দেশে ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪১২ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আমদানি বাবদ ৪৭০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
এদিকে গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরের শুরুতেও পণ্য বাণিজ্যে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই ও অগাস্ট মাসের বাণিজ্য ঘাটতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এই সময়ে বাংলাদেশের পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে ৮৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৬৭১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ডলার। সাধারণভাবে কোনও দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত জাগো বাংলা ২৪ ডট কমকে বলেন, ‘আমদানি ব্যয়জনিত কারণে রিজার্ভে কিছুটা চাপ থাকলেও ভয়ের কোনও কারণ নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ সরকারি বড় বড় বেশকিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় জিসিনপত্র আমদানি করতে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৯৯ কোটি (প্রায় ২২ বিলিয়ন) ডলার। ওই বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০২ কোটি (প্রায় ২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩ কোটি (প্রায় ৩০ বিলিয়ন) ডলার। একইভাবে ২০১৭ সালের ২১ জুন রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের জুনের পর থেকে রিজার্ভ আর বাড়েনি। ৩১ অক্টোবর, ২ নভেম্বর ও ২৮ ডিসেম্বর ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ফিরলেও এখন পর্যন্ত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ঢুকতে পারেনি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৬ বছরের মাথায় সেই রিজার্ভ গিয়ে ৩৩ বিলিয়নে ঠেকে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়লেও নির্বাচনের বছরে আস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ দিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।