বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলকে ‘চরম দুঃশাসন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। বাংলাদেশের নির্বাচন, ফলাফল, অনিয়মের অভিযোগ ও সহিংসতা বিষয়ে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের কারিগর ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা দক্ষিণ এশিয়ায় ও বাংলাদেশে নির্বাচনী সহিংসতার তুলনায় তেমন কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এদিকে নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রভাবশালী নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) রিসার্চ ফেলো শ্রুতি এস পাটনায়েক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রের অর্থ যদি হয় ভোটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক পালাবদল, তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেই পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে।’
অন্যদিকে ভারতীয় আরেক বিশ্লেষক পি কে বালাচন্দ্র বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়কে উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে অভিহিত করে একে পুরো অঞ্চলের জন্য শিক্ষা বলে মন্তব্য করেছেন।
নয়াদিল্লিভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে গত রবিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে ‘শেখ হাসিনা’স রিটার্ন টু পাওয়ার ইন বাংলাদেশ ডগেড বাই কন্ট্রোভারসি’ শীর্ষক নিবন্ধটি গতকাল মঙ্গলবার হিন্দুস্থান টাইমসে প্রকাশিত হয়। এরপর ওআরএফ তার ওয়েবসাইটে নিবন্ধটি প্রকাশ করে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা একাধিক নিবন্ধের জন্য রাজনৈতিক মহলে আলোচিত। এবারের নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে বিতর্ক আছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ হিসেবে অভিহিত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতি, ভোটার ও বিরোধী প্রার্থীদের হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, গ্রেপ্তার ও ভিন্ন মতকে দমনের অভিযোগ উঠেছে। তবে সার্ক, ওআইসি, ভারতসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়া নির্বাচনী চর্চার যে মান তাতে বাংলাদেশের নির্বাচনের সহিংসতাকে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখা যায় না।
তিনি আরো লিখেছেন, ‘অনিয়মের অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনই অনিয়ম ও সহিংসতা মুক্ত ছিল না।’
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে কূটনীতিক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়ের পর ওই জোটের ক্যাডারদের সহিংসতা দেখেছি। সংখ্যালঘু হিন্দুরা সেই সহিংসতার ক্ষত বহন করছে। সহিংসতা ও পেশিশক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছে।’
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন নতুন প্রজন্মের জন্য ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামপন্থী বিএনপি ও জামায়াতের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’—এমন পুরনো ধারণায় তারা বিরক্ত। এই রাজনৈতিক বিভাজনকে আবার তথাকথিত আওয়ামী লীগ এবং ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন জাতীয়তাবাদী (বিএনপি) হিসেবেও দেখা হয়। এই প্রজন্ম ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের চরম দুঃশাসনের তীব্র বিস্বাদও উপলব্ধি করেছে উল্লেখ করে পিনাক লিখেছেন, বিএনপি জোটের ওই শাসনামল দুর্নীতি, ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা ও হিন্দুদের আরো প্রান্তিকীকরণের জন্যও পরিচিত।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক এমন তলানিতে পৌঁছেছিল, যা বাংলাদেশিদের বড় অংশের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশিদের কাছে সবচেয়ে বড় বিরক্তির কারণ ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি নেতাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার ফল উপভোগ করতে দেখা। এই মনোভাব যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে ব্যাপক সমর্থন ও বিএনপি-জামায়াত জোটের যুদ্ধাপরাধী মন্ত্রীরাসহ জামায়াতের নেতাদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
পিনাক লিখেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের কারিগর তারেক জিয়া বিভিন্ন মামলায় ২০০৮ সালে জামিন নিয়ে লন্ডনের উপকণ্ঠে কিংস্টনে পালিয়ে আছে। তারেক যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জালিয়াতসহ সন্দেহভাজনদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য বিখ্যাত। মা খালেদা জিয়ার মতো তারেকও মুদ্রাপাচার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যায় ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত ও দণ্ডিত।’
শেখ হাসিনার এবারের বিজয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে পিনাক লিখেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফলাফলের পর প্রথম বিদেশি সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে ফোন করেছেন ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি আরো লিখেছেন, ‘হাসিনা আবারও ক্ষমতায় ফেরায় নয়াদিল্লি বেশ সন্তুষ্ট থাকবে। তাঁর সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো বেগবান হবে।’
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়নে ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত জোরালো সম্পর্ক গড়তে চেয়েছে। তাঁর (শেখ হাসিনার) ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে নিবিড় সম্পর্ক আরো জোরালো হবে।’
এদিকে আইডিএসএর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ জেনারেল ইলেকশনস টু থাউজেন্ড এইট : হোয়াট নেক্সট ফর দ্য অপজিশন’ শীর্ষক নিবন্ধে রিসার্চ ফেলো শ্রুতি এস পাটনায়েক লিখেছেন, এবারের নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা অতীতের তুলনায় বেশ কম। বিরোধী দলগুলোর খুবই কমসংখ্যক সংসদীয় আসনে বিজয়ী প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, বিরোধী দলমুক্ত সংসদ গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক নয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলো থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে তিনি মত দিয়েছেন। পাশাপাশি তরুণদের কর্মসংস্থানের ওপরও তিনি জোর দেন।
অন্যদিকে ভারতীয় আরেক বিশ্লেষক পি কে বালাচন্দ্র নিউজ ইন এশিয়া ডট নেটে ‘লেসন্স ফ্রম বাংলাদেশ ইলেকশনস ফর সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন এবং বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন—সর্বত্রই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভোটারদের কাছে মুখ্য ইস্যু হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও বিশ্লেষকরা বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও মাদক সমস্যা মোকাবেলায় কঠোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল।