ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শুধু কেন্দ্রে কিংবা ঢাকা মহানগর কমিটিতেই নয়; জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নসহ তৃণমূলের প্রায় প্রতিটি কমিটিতেই রয়েছেন অনেক অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতরা। দলের অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কেন্দ্র থেকে শুরু করে সকল স্তরের কমিটিতেও বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টিসহ বিভিন্ন দল থেকে অনুপ্রবেশ করেছেন অনেকে। দল টানা সাড়ে ১১ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকায় তুলনামূলক বেশি সুযোগ-সুবিধাভোগীও এই অনুপ্রবেশকারীরাই। খোদ যুদ্ধাপরাধীদের পোষ্যদের কেউ কেউ বিভিন্ন উপায়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করছেন। কব্জায় নিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনও। তাদের বিত্ত-বৈভব আর প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা প্রকৃত নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার বলেছেন, সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারীরাই দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাই তাদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। সুসময়ের বসন্তের কোকিল দুঃসময়ে থাকে না। দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা কখনও দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে না। রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির উদ্যোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি সংসদ ভবন এলাকাস্থ তার সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন্য অনুপ্রেবেশকারীরাই দায়ী। তাই আমি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলব, দলে কোনো স্তরে কোনভাবেই অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর প্রায় সর্বত্র অনুপ্রবেশকারীরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠলে তাদের বিষয়ে দলীয়ভাবে এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খোঁজ নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অনুপ্রবেশকারীদের তালিকাও করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান-নাতিরাও ঢুকে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বাগিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদ। পরবর্তী সময়ে দলীয় পদ ব্যবহার করে টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাতারাতি বনে গেছেন কথিত ‘বড় নেতা’ ও অঢেল অর্থ-বিত্তের মালিক। অর্থ আর দলীয় পদের প্রভাবে কোথাও-কোথাও স্থানীয় প্রশাসনও তাদের হাতের মুঠোয়। আবার কোথায়ও কোথায়ও অনুপ্রবেশকারীদের পদ আর অর্থের দাপটের কাছে প্রশাসনও অসহায়। কোনো কোনো স্থানে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইয়াবার আস্তানায় হানা দেওয়ার পর উল্টো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অন্যত্র বদলির শিকার হতে হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী নেতার মাদক আস্তানায় হানা দেওয়ার পর ঘটনা সাজিয়ে বলা হয়- বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করেছেন কর্মকর্তা। পরবর্তীতে তদন্ত ছাড়াই অভিযানকারী কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের ও দলীয় সংসদ সদস্যদেরও কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে অন্য দলের লোকজনকে দলে যোগদান করিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে নিজের পৃথক বলয় তৈরি করেছেন। যার প্রতিফলন দেখা গেছে গতবারের উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়ার্ডসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে। নিজস্ব বলয়ের মাধ্যমে প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে এসব নেতা-এমপিরা দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছেন। আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনেও অনুপ্রবেশকারীরা অতীতের মতো ঘটনা ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন নেতা জানান, গত সাড়ে ১১ বছরে একাধিক সময়ে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ অভিযানের সময় অনেক বিতর্কিত লোকজন দলে প্রবেশ করেছে। সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিচয় ও নতুন সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই না করার কারণেও এই অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে।
সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে- সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কার্যক্রম, ক্যাসিনো-মাদক ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই দলে অনুপ্রবেশকারী। যার কারণে এদের বিরুদ্ধে গতবছরের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগে প্রবেশের আগে তারা বিভিন্ন সময় অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধীরে-ধীরে তাদের অবস্থান পালটাতে থাকে। ঢাকায় ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিতরা এসেছেন ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে। সর্বশেষ রিজেন্ট গ্রুপের মালিক প্রতারক মো. সাহেদও একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সূত্র জানায়, ঢাকায় ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে রাজধানীর সাত নেতা এসেছেন ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও জাপা থেকে। এই সাতজন হচ্ছেন: ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, জি কে শামীম, শফিকুল আলম ফিরোজ (কালা ফিরোজ) ও লোকমান হোসেন ভুইয়া। এদের অনেকেই এখন কারাবন্দি।
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট একসময় যুবদলের নেতাদের সঙ্গে চলতেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে জি কে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদক। ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ বিএনপির এক নেতার ক্যাডার থেকে হয়ে যান আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের রাজনীতির সূচনা বিএনপি দিয়ে। মোমিনুল হক সাঈদ ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি হন বিএনপি নেতা লোকমান হোসেন ভুঁইয়া। এই লোকমান হোসেনের ক্যাডার হিসেবে বিএনপির রাজনীতিতে আগমন ঘটে সাঈদের। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার রাজনীতির শুরু ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রবাজ ক্যাডার হিসেবে। ১৯৮৭ সালে খিলগাঁওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মানিক ও মুরাদের মাধ্যমে ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন তিনি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশে কখন কী ঘটে বলা যায় না। এজন্য দলের নেতাকর্মীদের ক্ষমতার দাপট না দেখানোর জন্য সতর্ক করে দেন তিনি। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, চিরজীবন আমরা ক্ষমতায় থাকবো এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবেন না, আমরাও ভাবি না। চোখের পলকে বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট ঘটে গেছে। হঠাত্ করে ২১ আগস্ট। ক্ষমতায় থেকে যে যেখানে আছেন ক্ষমতার দাপট দেখাবেন না। যখন ক্ষমতায় থাকবেন না প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ নেবে।