অর্থ পাচারকারীদের কাছে দেশটা মগের মুল্লুক—এমনটাই মনে করছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, সমস্ত জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে, এটা হতে পারে না। দেশটা কি মগের মুল্লুক? অবশ্যই তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ভার্চুয়াল ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এই মন্তব্য করেন। এছাড়া সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে) বিদেশে পালিয়ে থাকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে আদালত। তিনি কোন দেশে আছেন এবং তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেওয়া এই আদেশ প্রাপ্তির ১০ দিনের মধ্যে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলার তথ্যসহ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে দুদক চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এই অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আটকদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা পাচারের মামলা রয়েছে। ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে এ বছরে আলোচিত মামলাটি দায়ের করে সিআইডি। ঐ মামলায় ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরকতসহ বেশ কয়েক জনকে আসামি করা হয়। দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই দেশের কোনো সংস্থার কাছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) এর প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছরে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে আরো ৫৯০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত ১১ বছরে মোট পাচার হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বর্তমানে বাজার দরে এর মূল্যমান ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
জিএফআইয়ের ঐ প্রতিবেদনে ১৪৮টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশে অর্থ পাচারের তথ্য দেওয়া হয়। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৯তম। অর্থ পাচারের বিষয়টি তদারকি করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিশ্বের অন্য দেশের সংস্থাগুলোর সঙ্গে এই ইউনিট কাজ করে থাকে। আর অর্থ পাচারের বেশির ভাগ মামলারই তদন্ত করে দুদক ও সিআইডি। এছাড়া গত বুধবার ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে রাজনীতিবিদরা নন, সরকারি কর্মচারীরাই বেশি।
সূত্র জানায়, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে ৩৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন পিকে হালদার। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকা ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কৌশলে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ করেন তিনি ও তার সহযোগীরা। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ১৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরে তিনি পাড়ি জমান কানাডায়। গত জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট পিকে হালদার ও তার আত্মীয়স্বজনসহ ১৩ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ, সকল সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেয়। এমতাবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন দিয়ে বলা হয়, দেশে ফিরতে চান পিকে হালদার। থাকতে চান আদালতের কাস্টডিতে। গত ২১ অক্টোবর বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, বিমানবন্দরে অবতরণের পরই যেন পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু উনি দেশে না ফিরে দুবাই থেকে আবার কানাডায় পাড়ি জমান।
সম্প্রতি দুদক ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিভিন্নপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরকম একটি প্রতিবেদন গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চের নজরে আসে। তখন দুদক কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খানের উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, পত্রিকা পড়ে আমরা পিকে হালদারের বিষয়টি জানতে পেরেছি। এ ধরনের প্রতিবেদন নজরে আসলে আদেশ না দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারি না। উনার বর্তমান অবস্থান কি?
দুদক কৌঁসুলি বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সে পলাতক। দেশে ফিরে আসার জন্য আদালতের কাছে ওয়াদা করলেও তিনি আসেননি। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সে অনেক টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে। সেটার তদন্ত চলছে। হাইকোর্ট বলে, কেউ দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করবে আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে তার সুযোগ কোথায়? কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে অবশ্যই দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এত টাকা সে কীভাবে আয় করেছে, কীভাবে বিদেশে পাচার করেছে? সেটা জানা দরকার। আদালত বলে, একজন মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে বিদেশে নিয়ে গেল? এ বিষয়ে অব্যশই যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
শুনানি শেষে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের পাশাপাশি রুল জারি করে হাইকোর্ট। রুলে পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কিংবা গ্রেপ্তারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহজাবিন রব্বানী দীপা উপস্থিত ছিলেন। ইতিমধ্যে দুদক ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ঐ মামলায় তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ।