কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের লেলিহান শিখায় প্রায় ১০ হাজার ঘর ভস্মীভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে বালুখালী ক্যাম্প ৮-এর ই ও ডব্লিউ ব্লকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। তবে রাত ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাতাসের গতি বেশি হওয়ায় আগুন ৮-ই ও ডব্লিউ ব্লক ছাড়িয়ে দ্রুত ৯ এবং ১০ নম্বর ব্লকেও ছড়িয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে রোহিঙ্গা আবাল বৃদ্ধ বনিতা। প্রাণহানি এড়াতে বিভিন্ন ব্লক থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রোহিঙ্গারা দ্রুত সরে যায়। তবে রাত ১২টার দিকে কয়েকজনের পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঐ ছবিগুলো গতকালের অগ্নিকান্ডের কি-না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা ৮ জনের লাশ উদ্ধার করতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে দায়িত্বশীল কোন কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর খবর গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি।
ক্যাম্পে কাজ করা এনজিওদের সমন্বয়কারী সংস্থা ‘ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেটর গ্রুপ- আইএসসিজির ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার সৈয়দ মো. তাহফিম রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে জানান, স্থানীয়রা আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে গেলেও তাপের তীব্রতায় কাছাকাছি যেতে পারেনি। খবর পেয়ে উখিয়া-টেকনাফ-রামু ও কক্সবাজার সদর থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র ব্যবহারের কাপড় ও সামনে পাওয়া প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
এদিকে ক্যাম্প ভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তৈরি ১৮ জানুয়ারির একটি শিটের হিসাব অনুসারে জানা গেছে, বালুখালীর ক্যাম্প ৮-ইতে ঘরের সংখ্যা ৬ হাজার ২৫০ আর লোকসংখ্যা ২৯ হাজার ৪৭২ জন, ৮-ডব্লিউ ক্যাম্পে বাড়ি ৬ হাজার ৬১৩টি আর লোকসংখ্যা ৩০ হাজার ৭৪৩ জন, ক্যাম্প ৯-তে বাড়ি ৭ হাজার ২০০টি আর লোকসংখ্যা ৩২ হাজার ৯৬৩ জন এবং ক্যাম্প ১০-তে বাড়ি ৬ হাজার ৩২০টি আর লোকসংখ্যা ২৯ হাজার ৭০৯ জন।
আগুন লাগার পর ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের এত পরীক্ষায় কেন ফেলছেন বুঝে উঠতে পারছি না। মিয়ানমারের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যে বাংলাদেশেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চরম আতঙ্কিত করে তুলেছে।’ মো. রফিক উদ্দিন নামে অপর এক রোহিঙ্গা বলেন, ৮ নম্বর ক্যাম্পে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য তার। একটি ট্রাঙ্ক ও বালতি নিয়ে পালানোর সময় লায়লা বেগম (৪৫) নামে রোহিঙ্গা বলেন, আজকের আগুনের ভয়াবহতা আবারও আমাদের মিয়ানমারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
বালুখালি ক্যাম্প ৮ ই-এর ক্যাম্প ইনচার্জ মোহাম্মদ তানজীম সন্ধ্যায় জানান, আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনসহ রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা। এ মুহূর্তে আগুনের সূত্রপাত ও হতাহত সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।
কক্সবাজারের ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক অতিরিক্ত কমিশনার মো. সামছুদ্দৌজা নয়ন জানান, প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও রাত ১০টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনই বলা মুশকিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এনজিওর কয়েকটি ভবনেও আগুন হানা দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনজিওর কয়েকজন কর্মী বলেন, অগ্নিকান্ডে ৩টি ক্যাম্পে অন্তত: ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত শিশু ও বৃদ্ধসহ ৮ জনের মৃত্যুর খবর শুনেছি। তবে, বিষয়টি সরকারি কিংবা ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট কোন সূত্র স্বীকার করেনি।
অপরদিকে, অগ্নিকাণ্ড স্থলে আগুন না লাগা ঘরে খোদ রোহিঙ্গা উগ্রপন্থী কিছু তরুণ কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালাতে তত্পর হয়। এমন ৮ যুবককে স্থানীয়দের সহায়তায় আটক করেছে ক্যাম্পে কাজ করা এপিবিএন সদস্যরা। বালুখালী এলাকার দেলোয়ার হোসাইন টিসু নামে এক যুবক তার ফেসবুকে লিখেছেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি রোহিঙ্গারা আগুন ধরাই দিছে। দয়াকরে সবাই নিজ এলাকায় পাহারা দিন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সকাল থেকে তাদের রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।