করোনার মতো সংকট আগে কখনো আসেনি। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অন্যদিকে কর্ম হারানোর আশঙ্কা। এ সময়ে মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে সঞ্চয়ও কমে যাওয়ার কথা। তবে কথায় বলে, সংকটে সঞ্চয় বাড়ে। এ রীতি অনুসরণ করে ব্যাংক খাতে সঞ্চয় বেড়েছে। একইভাবে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বেড়েছে আমানতের চাপ।
ব্যাংকগুলো আমানতের ওপরে সুদের হার কমিয়ে দিলেও মানুষ টাকা রাখার জন্য ব্যাংককেই বেছে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে তথা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে গত জুলাই-জানুয়ারি—এই সাত মাসে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এক বছরে ৮৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এরপরও ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাকি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে রয়েছে। এদিকে করোনার সময়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের আমানত বেশি বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে। হিসাবমতে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যাংকে রাখা আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৯ এ বেড়েছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
সুদহার কমে যাওয়ার পরও কেন মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে—এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, মানুষের আয় কমলেও নানা কারণে ব্যাংকের প্রতি আস্থাও বেড়েছে। প্রবাসীরা যে টাকা পাঠাচ্ছে, তার একটা অংশ ব্যাংকে থেকে যাচ্ছে। ফলে আমানতে সুদ হার কমলেও ব্যাংকে টাকা রাখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এছাড়া করোনা সবাইকে ভবিষ্যত্ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার কারণেই সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে বলে জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে লাভ পাওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রে সমস্যা হলো—মেয়াদ পূর্তি না হলে ঐ অর্থ থেকে কোনো লাভ পাওয়া যায় না। এ কারণে সবাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন না। আবার ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে টাকা রাখতেই পছন্দ করেন। করোনাকালে ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়েনি। নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারেনি তারা। ফলে ব্যাংকেই টাকা রাখতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার সময়ে আয় কমে গেছে। যে কারণে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া খরচ কমিয়ে দিয়েছে। আর ভবিষ্যতের বিপদ থেকে সুরক্ষায় থাকার জন্য অল্প অল্প করে ব্যাংকে জমাচ্ছে। ফলে আমানত বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। গত ডিসেম্বর শেষে এই ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। গত জানুয়ারির শেষে ব্যাংকটিতে আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের জুনে ছিল ১ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ বেড়ে গত ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৯০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এক বছর আগে তথা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষে আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ২০২ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
এদিকে, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বেড়েছে আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) সংগৃহীত আমানত ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা বেড়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ৪৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। দেশে কার্যরত ৩০টি বেসরকারি লিজিং ও ফাইন্যান্স কোম্পানির হাতে এই পরিমাণ আমানত রয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে আমানত ছিল ৪১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। এর বাইরে চারটি সরকারি এনবিএফআই রয়েছে, যেগুলো জনসাধারণের কাছ থেকে কোনো ধরনের আমানত সংগ্রহ করে না।