সোয়া দুই বছর ব্যবধানে আজ রোববার থেকে ফের দেশের দুই শেয়ারবাজারে ফ্লোর প্রাইসসহ শেয়ার কেনাবেচা শুরু হচ্ছে। এর মাধ্যমে আবারও নিয়ন্ত্রিত বাজার প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে, যেখানে নির্দিষ্ট দরের নিচে কোনো শেয়ার কেনাবেচা হতে পারবে না। ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে লেনদেন ছাড়াই কোনো কোনো শেয়ারের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সোয়া দুই বছর আগেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দিনের পর দিন ক্রেতাশূন্য ছিল শত শত শেয়ার। পরে কারসাজির সুযোগে বাজারে মোড় ঘুরেছিল। নতুন করে এভাবে বাজার ঘোরানো যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় সবার মধ্যে।
সার্বিক অবস্থা দেখে অর্থনীতিবিদ, শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্ট এবং শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক এক প্রধান বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার নজির বর্তমান বিশ্বে আর একটিও নেই। বারবার বড় সংকট তৈরি হওয়া এবং তা মোকাবিলায় অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণ এ বাজারের দৈন্য এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার বহির্প্রকাশ বলে মনে করেন তিনি।
ফ্লোর প্রাইস আরোপের আগে মুহূর্তেও বাজারে অসম নিয়ন্ত্রণ ছিল জানিয়ে বাজার-সংশ্নিষ্টরা বলেন, নির্দিষ্ট দিনে কোনো শেয়ার ১০ শতাংশ বাড়তে পারবে; কিন্তু ২ শতাংশের নিচে কমতে পারবে না- এ নিয়ম বৃহস্পতিবারও ছিল। বিশ্বের অন্য কোনো শেয়ারবাজারে এমন ব্যবস্থা প্রচলনে নেই।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, এ অবস্থা হাতে ধরে তৈরি করা। খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এ বাজার নিয়ে একের পর এক ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেই যাচ্ছে। তারা যা করছে, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে তিনি তা কল্পনাও করতে পারেন না। যাঁরা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরাও অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক। ‘মুক্তবাজার’ অর্থনীতিতে এভাবে শেয়ারদরকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে কী করে তাঁরা বাজার ধারণার বিপরীতে চিন্তা করছেন, সে প্রশ্ন তাঁরও। ফ্লোর প্রাইসের কারণে মার্জিন ঋণ নিয়ে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা কেনাবেচা না করেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও যুদ্ধাবস্থার কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে নানামুখী শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার খবর দেখে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন, বড় দরপতন হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে হয়তো বাধ্য হয়ে ফ্লোর প্রাইস দিয়েছে কমিশন। তবে এর মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সংকটের সমাধান হবে কিনা, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
একই ধরনের মত বিএসইসির সাবেক কমিশনার এবং বর্তমানে শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামক সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খানের। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিশ্বের ছোট-বড় সব শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। ইউরোপের বাজারে ১৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়ার সব বাজারেই খারাপ অবস্থা। তার পরও কোনো বাজার ফ্লোর প্রাইস দেয়নি। আবার এটাও ঠিক, দরপতন হলে পৃথিবীর অন্য কোনো শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা তাঁদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়ী করেন না, যা বাংলাদেশে হয়।
আরিফ খান বলেন, দরপতনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়ী করার প্রবণতা বাংলাদেশের বাইরে আর কোথাও নেই। এ কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ‘নার্ভাস’ থাকে এবং পতন হলে ঠেকানোর চেষ্টা করে। তারা যেসব পদক্ষেপ নেয়, তার পক্ষে তাদেরও কিছু যুক্তি থাকে। অবশ্য সে যুক্তি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে এবং বেশিরভাগ সময় এসব পদক্ষেপ কাজে আসে না। যেমন- কোনো শেয়ার ১০ শতাংশ বাড়তে পারবে; কিন্তু ২ শতাংশের নিচে কমতে পারবে না- এ পদক্ষেপের ব্যাপক সমালোচনা আছে। কারণ এ পদক্ষেপ দরপতন ঠেকাতে পারেনি।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ আরও বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের প্রধান সমস্যা হলো এ বাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীনির্ভর। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিতে আইপিও এবং সেকেন্ডারি বাজারে জুয়াড়িদের অভাব নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা নিয়ন্ত্রক সংস্থা করে না। এ অবস্থায় কী করে একটি স্বাভাবিক বাজার প্রতিষ্ঠা হবে- প্রশ্ন তাঁর।
এসব বিষয়ে জানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও সাড়া দেননি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম এ-সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনে কোনো উত্তর দেননি।