মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মধ্যেও সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই ঋণের প্রবাহ বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবাহও বেড়ে গেছে। এতে মুদ্রানীতির উপকরণগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওই দুই ধরনের ঋণপ্রবাহে লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হারসহ বিভিন্ন ধরনের স্বল্প সুদের ঋণ তহবিলের সুদ বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে রেপো সুদের হার তিন দফা ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সুদের হার দুই দফা বাড়ানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ঋণপ্রবাহে লাগাম পড়বে। অর্থনীতির গতিপ্রবাহের মধ্যে ঋণের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তাতে হঠাৎ করে লাগাম টানা যাবে না। ধীরে ধীরে টানতে হবে। এছাড়া সরকার তার ঋণনীতির মধ্যে থাকছে না। যে কারণে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশিমাত্রায় বেড়েছে। রপ্তানির চাহিদা ও আগের ঋণের সুদ যোগ হয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারির শেষদিকে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমে দাম আরও বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। এর প্রভাব ও দেশের বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হারও বাড়তে থাকে।
গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ার কারণেও মূল্যস্ফীতির পালে হাওয়া লাগে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ঘোষণা দেয়। ঋণের প্রবাহ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ঋণপ্রবাহ তো কমেইনি। বরং আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল ২ দশমিক ০১ শতাংশ। ওই সময়ে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে প্রায় দশমিক ২৮ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ায় অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ২ দশমিক ০৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি সরকার। বরং আগের ঋণ পরিশোধ করেছিল ৪৮১১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ নিয়েছে ২৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ বাড়লেও নন-ব্যাংকিং খাত থেকে কমেছে। গত অর্থবছরে জুলাই-আগস্টে নিয়েছিল ৪৪ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে নিয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করার কারণে এ খাত থেকে সরকারের ঋণের জোগান কমেছে।
ঋণপ্রবাহে লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিনির্ধারণী রেপো সুদের হার তিন দফা বাড়িয়ে পৌনে ৬ শতাংশ করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সুদের হার দুই দফা বাড়িয়ে ২ থেকে ৪ শতাংশ করেছে। আরও কিছু খাতে সুদ বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি বেড়েছিল ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল ৫০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে। কিন্তু বেশি দামে আমদানি করায় পণ্যের দামও বেড়েছে। এতে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিতে চাপ বেশি পড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলোই ছিল মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার অন্যতম কারণ। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে ও অক্টোবরে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নামে। মূল্যস্ফীতির হার কমলেও ওই সময়ে পণ্যমূল্য বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারের দিকে তাকালে মনে হয় না মূল্যস্ফীতির হার কমেছে। পণ্যমূল্য যখন বাড়ে, তখন মূল্যস্ফীতির হার কীভাবে কমে? নিশ্চয় হিসাবের মধ্যে ফাঁকি আছে। একটি তথ্য দিয়ে বাজারকে তো আর থামানো যাবে না। বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে। কিন্তু বাজার তদারকির মাধ্যমে এটা কিছুটা হলেও থামিয়ে ভোক্তাদের উপশম দেওয়া সম্ভব।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জোগানে সংকট সৃষ্টি করেছে। কেননা দেশের মোট আমদানি ব্যয়ের ৬০ শতাংশ আগে রপ্তানি আয় দিয়ে মেটানো যেত। বাকি ৪০ শতাংশ মেটানো হতো রেমিট্যান্স দিয়ে। এতে রেমিট্যান্স আরও উদ্বৃত্ত থাকত, যা রিজার্ভে যোগ হতো। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। রেমিট্যান্স কমায় এখন আর রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। বরং রিজার্ভ থেকে অর্থ দিতে হচ্ছে আমদানি ব্যয় মেটাতে। এতে একদিকে রিজার্ভ কমছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স থেকে জোগান না আসায় রিজার্ভ বাড়ছে না।
গত বছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স কমেছিল ২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ২ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে কমেছিল ২২ শতাংশ। গত অক্টোবরে কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছিল সাড়ে ২২ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৭ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে বেড়েছিল ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অক্টোবরে কমেছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমায় এবং আমদানি ব্যয় বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার জোগানে ঘাটতি বেড়েছে।
এদিকে পণ্যমূল্য বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গেছে। বরং সঞ্চয় তুলে এখন জীবিকা নির্বাহ করছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়েছিল ২৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১১ হাজার ১৫৬ হাজার কোটি টাকা। আমানত কমেছে অর্ধেকের বেশি।
একই অবস্থা সরকারি সঞ্চয়পত্রে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছিল ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছে ৩৩১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে সুদ ও মূল টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বেশি। অবশ্য সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার ইচ্ছা করেই সঞ্চয়পত্র বিক্রির নীতিমালা কঠোর করেছে। এতে বিক্রি কমেছে।