বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শনিবার (২৩ নভেম্বর) একটি অডিও রেকর্ড প্রচার করা হয়। সেই রেকর্ডে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে মূলত দাবি করা হয়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
ফ্যাক্টচেকিং বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদকে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে’ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়। রিউমার স্ক্যানার রোববার এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরেছে।
রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, অডিওতে শেখ হাসিনা বলেন:
‘আবু সাঈদ গুলি খাওয়ার পর তার সঙ্গী–সাথিরা যে তাঁকে টেনে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল? যার গুলি লাগবে, তাকে তো সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। হাসপাতালে নিলে, অপারেশন করবে, বুলেট বের করবে, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আবু সাঈদকে কিন্তু হাসপাতালে নেয় নাই। নিয়েছিল চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে। চার-পাঁচ ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেওয়ার পর, ডাক্তাররা যখন চিকিৎসা করে, তখন সে মৃত্যুবরণ করে।’
শেখ হাসিনার এই বক্তব্যে মূলত দাবি করা হয়েছে যে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
ফ্যাক্ট চেক
রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদকে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে’ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং বেলা ২টা ১৮ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ার পরই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। তিনটার দিকেই রিকশা করে তাঁকে হাসপাতালে পৌঁছানো হয়।
রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই দ্য ডেইলি স্টার-এ বিকেল ৪টা ১ মিনিট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেদিন বেলা আনুমানিক আড়াইটার দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আবু সাঈদ নিহত হন। ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দিন বেলা ২টার দিকে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় আহত হন আবু সাঈদ। পরে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আশিকুল আরেফিন।
পরে রিউমার স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ার মুহূর্তের সময় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঘটনার দিন বেলা ২টা ১৬ মিনিটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির ফেসবুক পেজের একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ওই লাইভ ভিডিওটির ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডে আবু সাঈদকে গুলিবিদ্ধ হতে, ১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে তাঁকে রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে এবং ১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে কয়েকজন ব্যক্তিকে তাঁকে (সাঈদ) তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। লাইভ ভিডিওর টাইমলাইন অনুযায়ী, আবু সাঈদ বেলা ২টা ১৮ মিনিটে নিস্তেজ অবস্থায় রাস্তায় ঢলে পড়েন।
আরও অনুসন্ধানে ‘Fahmed Riad’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সেদিন ১৬ জুলাইয়ের পোস্টে রিকশায় আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়ার সময়ের একটি ছবি পাওয়া যায়, যার টাইমফ্রেমে ছবিটি ২টা ২৭ মিনিটে তোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
অপর দিকে বেলা ৩টা ৫৯ মিনিটে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এক প্রতিবেদনে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া আবু সাঈদের মৃত্যুর প্রমাণপত্রের ছবি পাওয়া যায়। প্রমাণপত্র অনুযায়ী, আবু সাঈদকে বেলা ৩টা ৫ মিনিটে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বিকেল ৪টা ১৮ মিনিটে ঢাকা পোস্টের একটি প্রতিবেদনেও মৃত্যুর প্রমাণপত্রের অন্য একটি ছবি পাওয়া যায়।
দৈনিক ডেইলি সানের বাংলা সংস্করণে ৪টা ১৩ মিনিটে আবু সাঈদের মৃত্যুর ব্যাপারে হাসপাতালের মৃত্যুর প্রমাণপত্রের তথ্যের বরাতে লেখা হয়, আবু সাঈদকে বেলা ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ফেসবুক পেজ BRUR Campus এ ‘সরাসরি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে’ শিরোনামে বেলা ৩টা ৫৯ মিনিটের একটি লাইভে শিক্ষার্থীদের আবু সাঈদের মৃত্যুর প্রতিবাদে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে মিছিল করতে করতে রংপুর মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে মূল সড়কে আসতে দেখা যায়।
উপরিউক্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, আবু সাঈদকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৪-৫ ঘণ্টা পর নয়, বরং সেদিন গুলিতে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ার পরই তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং বেলা ৩টার দিকে রিকশা করে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে আবু সাঈদের মৃত্যু
আবু সাঈদের মৃত্যুর ২ মাস ৮ দিন পর প্রকাশিত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাঈদের মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির চিহ্ন। ছররা গুলি ঢুকে তাঁর শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশে গর্ত তৈরি করেছিল। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর মাথার বাঁ দিকেও আঘাতের কারণে রক্ত জমাট ছিল।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আবু সাঈদের খাদ্যনালি ও ঊরুর রক্তনালি জখমের কারণে রক্ত জমাট বাঁধে। এই রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদ শকে চলে যান ও মৃত্যু ঘটে।
ময়নাতদন্তের বিষয়ে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘অসংখ্য ছররা গুলির আঘাতে আবু সাঈদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় এবং তাঁর অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া আপনারা দেখেছেন যে সাঈদ ডান পায়ে হাত দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তাঁর ডান ঊরুতেও ছররা গুলি লেগেছিল। সেখানে ফিমোরাল আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। তলপেটেও গুলির আঘাত ও রক্তক্ষরণ পেয়েছি। এসব আঘাতের কারণে শক ও রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।’
আবু সাঈদের মাথায় আঘাতের বিষয়ে রাজিবুল ইসলাম বলেন, তাঁর মাথার বাঁ দিকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেটি তিনি পড়ে গিয়ে বা পারিপার্শ্বিক অন্য কারণে হতে পারে। তবে এটি মৃত্যুর কারণ নয়। তাঁকে গুলি করা না হলে তাঁর মৃত্যু হতো না।
উল্লেখ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বরে ভিন্ন এক শিক্ষার্থীর ছবিকে আবু সাঈদের দাবি করে তাঁর মৃত্যু নিয়ে অপতথ্য প্রচার হলে সে বিষয়ে একটি ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমার স্ক্যানার টিম। সে সময় ওই পোস্টগুলোতেও আবু সাঈদকে ৫ ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেওয়ার দাবি করা হয়েছিল, যা ওই ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে অসত্য হিসেবে শনাক্ত করে রিউমার স্ক্যানার।
সবশেষে রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুতরাং গুলিবিদ্ধ হওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল দাবিতে প্রচারিত বিষয়টি মিথ্যা।