লুৎফুর রহমান কাজল, ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার-৩ (সদর, রামু, ঈদগাঁও) আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় ব্যাপক বিতর্ক ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়া সেই সাবেক সংসদ সদস্য এবং দলের মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজলকে ঘিরে নানা অভিযোগ উঠছে। সন্ত্রাস, দখলবাজি, বন ও পাহাড়ের ধ্বংস, চোরাচালান ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মতো অসংখ্য অভিযোগে তিনি ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত। এসব অপকর্মের জন্য তিনি এলাকার মানুষের চরম অসন্তোষ ও শঙ্কা সৃষ্টি করেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ‘নিরিবিলি সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত দখল ও চোরাচালানকারি চক্রের উত্তরসূরি এই ব্যক্তিটি বছরের পর বছর সরকারি খাসজমি, পাহাড়, সৈকত দখল করে এসেছে। এছাড়াও, চিংড়ি প্রজেক্টে হামলা, হোটেল দখল ও আন্তর্জাতিক চোরাচালানের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তিকে গণতন্ত্র ও পরিবর্তনের সংকল্পের নামে মনোনয়ন দিয়ে এলাকাবাসী মনে করছেন, এটি আসলে ‘অপরাধের পুরস্কার’। ফলে, প্রার্থী হিসেবে কাজলের নাম ঘোষণা হওয়ার সাথে সঙ্গে মাত্রা ছাড়িয়ে ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
এই নির্বাচনে বিএনপি কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যত, কক্সবাজার-৩ আসনে কাজলের নাম প্রকাশিত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্প্রতি তিনি সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে কক্সবাজারের এক পাঁচতারকা হোটেল ‘রামাদা’ দখলের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা আরও বলছেন, পারিবারিক ‘কালো টাকার জোরে’ রাজনৈতিক পদ পেয়ে তিনি এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের লাইসেন্স খোরছেন।
অপরাধের বিষয়ে অনেকে জানান, রক্তক্ষয়ী July গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত উপজেলায় ‘ফ্যাসিস্ট মানসিকতার’ নেতাদের খুব সহজে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানতে নারাজ সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলার তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজল দখল, চোরাচালান ও সন্ত্রাসের বিশাল জগৎ পরিচালনা করছেন। তিনি সরকারি জমি, ভূ-সম্পদ, সমুদ্র সৈকতের বালি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। তার ভয়ঙ্কর প্রভাবের কারণে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। অনেকের মুখে শোনা যায়, কাজল কক্সবাজারের উপকূলীয় পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছে। তার গুদামে আসা চোরাই লবণ, অস্ত্র ও অন্যান্য পণ্য মজুদ রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
স্থানীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর ক্ষমতার মধ্যে তিনি সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে কোনও বাধা না পেয়ে রাজনীতি করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কাজল। তার সহযোগিতায় তিনি বহু সময় নিয়মতান্ত্রিক ব্যাঘাত হয়নি। ৫ আগস্টের ঘটনায় তার সহযোগিতা থাকায় তৎকালীন মেয়র মুজিবুর রহমান পালানোর জন্য সহায়তা পান।
২০০৮ সালে কক্সবাজারকে আধুনিক পর্যটন নগরীতে রূপান্তর ও লবণ চাষীদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু, বাস্তবে তার কর্মকাণ্ড এই এলাকার উন্নয়নের বদলে নানা অপকর্মে পরিণত হয়েছে। চোরাচালান, লুটপাট ও দখল-দুর্নীতির মহোৎসবের জন্য তিনি স্ব স্ব অবদানের জন্য পরিচিত।
নির্বাচনী এলাকায় মুখ খুলতে চান না অনেকেই, যেহেতু তারা বিস্তারিত জানেন তার অতীতের অপরাধের ব্যাপারে। বরং অনেকে বলছেন, তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে দখলদারি, চোরাচালান ও দখলবাজির সঙ্গে জড়িত ও তার পরিবারের অপরাধের ইতিহাস বেশ পুরনো। তার পিতা মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি ‘নিরিবিলি গোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা, চোরাচালানের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। তিনি আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলেন, অর্থও কামিয়েছেন।
জানা যায়, কাজলের ভাই মশিউর রহমান রাজনও দখল ও চোরাচালানে যুক্ত। এর পাশাপাশি, সীমান্ত পাস করে মিয়ানমারে সার, অস্ত্র ও অন্যান্য চোরাচালান চালানো তাদের পরিবারের প্রধান ব্যবসা।
অভিযোগ, তার পিতা ও পরিবারের মাধ্যমে এক অন্ধকার জগৎ তৈরী হয়েছে। বিভিন্ন মামলার অভিযোগেও জানা গেছে, ২০২২ সালে পোকখালি ইউনিয়নের চিংড়ি প্রজেক্টে দখল ও অগ্নিসংযোগ, মাছনষ্টের ঘটনা, বৈধ মাছ ও জাল লুটসহ নানা অপকর্ম করেছেন কাজল।
তাছাড়া, তার বিরুদ্ধে উপজেলায় বৌদ্ধ বিহারে হামলার প্ররোচনার অভিযোগও ওঠেছে। সরকারি জমি, পাহাড় কেটেও দখল—এরকম বহু অপরাধের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ চোরাচালান, বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে আওতায় আসা বিভিন্ন পণ্য চলাচলের সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব অপরাধে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও, টাকার জোরে অনেকটাই এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন।
স্থানীয় সূত্র বলছে, কাজলের দখলে রয়েছে পোঁকখালী গোমাতলী এলাকার বিশাল গুদাম। এই গুদামে মূলত চোরাই লবণ, অস্ত্র ও অন্যান্য চোরাচালান পণ্য জমা হয়।
সন্ত্রাসী ও দখলদার সিন্ডিকেটের ভয়াবহ দিকগুলো আরও স্পষ্ট, যেমন গত ১৫ অক্টোবর বিএনপি নেতা সেলিম রেজা ও যুবদলের নেতা এনামুল হকসহ প্রায় ১০০ জন সশস্ত্র দখলদার দলের ব্রত ‘হোটেল বে-কুইন’ দখলের ঘটনা। এ ধরনের আরো অনেক প্রতিষ্ঠান দখলের জন্য তাঁরা সক্রিয়।
নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশে, ‘রংধনু গ্রুপের’ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ওরফে ‘আন্ডা রফিক’ এর সঙ্গে কাজল হাত মিলিয়েছেন বলে জানা গেছে। মিথ্যাচার ও হুমকি দিয়ে পর্যটন শিল্পের মূল হোটেল ‘রামদা’র দখল নেয়ার অপচেষ্টাও শুরু করেছেন। এমন অভিযোগও উঠেছে, প্রবাসী ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন ও তার নামকে ব্যবহার করে নানা ফাঁদ সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার অপপ্রচারের ফলে, জসিমের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার ছড়ানো হচ্ছে, আর অন্য দিকে জসিমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগও চলছে।
পাহাড় কাটার, বন ধ্বংসের ব্যাপারে এক কক্সবাজার বনবিভাগের কর্মকর্তা জানান, ২০০৮ সালে নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এই ধ্বংসপ্রথার ভয়াবহতা শুরু হয়। বিশেষ করে, পাহাড় কাটার প্রবণতা অভিযুক্ত ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা চালিত। বর্তমানে, ইসলামপুরের সভাপতি আবুল কালামসহ অনেকের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটা ও দখলের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যেখানে কাজলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। এমনকি চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বন অফিসের বাধা উপেক্ষা করে তিনি দখল ও স্থাপনা নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাড়িতে জানা যায়, তার পারিবারিক রাজনৈতিক যোগ্যতা খুবই কম। তবে, কালো টাকার জোরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তার পদোন্নতি হয়েছে। বছরের পর বছর প্রভাবশালী গোপন সংযোগে তিনি দলীয় রাজনীতি চালাচ্ছেন।
জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কাজল একজন চিহ্নিত অপরাধী ও দখলদার, তার নির্বাচনে বিজয় হলে এই এলাকার পর্যটন শিল্পের জন্য ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। তার আচরণ ও কর্মকাণ্ড এই এলাকার উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ অভিযোগের বিষয়ে, তিনি অসঙ্গতিপূর্ণভাবে যোগাযোগের জন্য অক্ষম। তবে, জনগণ ও বিশ্লেষকদের মনে গভীর শঙ্কা রয়েছে, এই ব্যক্তির নির্বাচনে বিজয় হলে এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও পরিবেশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

