শ্রম আইন সংশোধনীতে মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা একান্তই গুরুত্বপূর্ণ, তবে একই সঙ্গে শিল্পের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও অপরিহার্য। বক্তারা এ বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছেন, আইন সংশোধনের সময় এমন কিছু পরিবর্তন আনা দরকার যাতে শ্রমিক ও মালিক উভয়ই সন্তুষ্ট হয় এবং শিল্পের উন্নয়নও অব্যাহত থাকে।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সলিডারিটি সেন্টার আয়োজিত একটি স্টেকহোল্ডারস সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে। এই বৈঠকটি বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬ এর সংশোধনী ও খসড়া পরিবর্তনসমূহ নিয়ে তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়, এতে শ্রমিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা, শ্রমআইনজীবী, মালিকপক্ষ, শ্রম সংস্কার কমিশন (এলআরসি), সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
আলোচনায় মূল লক্ষ্য ছিল সংশোধনীগুলো কি কি দিক থেকে ইতিবাচক এবং সম্ভাব্য দুর্বলতা কোথায়, তা বিশ্লেষণ করা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই সংশোধনীগুলোর প্রয়োগে শ্রমিক, মালিক ও নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ ঐক্যমত ও সমন্বয়ে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সেমিনারে বক্তারা সংশোধনীগুলোর বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন। একেএম নাসিম, সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, বলেন যে, ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকের প্রয়োজনীয় সংখ্যা নির্ধারণের জন্য এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের প্রস্তাবটি বেশ এগিয়ে যাবার চেষ্টার মতো হলেও, এতে কিছু কারিগরি অসামঞ্জস্য রয়েছে যা বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদিও সংশোধনী তত্ত্বগতভাবে ভালো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এর ফাঁক ও ফোকরও দেখা দিতে পারে।
এলআরসি কিছু সুপারিশ অগ্রাহ্য হওয়ায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এলআরসি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল, যা অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল সংযুক্ত হবে, কিন্তু শেষমেশ তা করা হয়নি।
মালিক পক্ষের প্রতিনিধি বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বেশ কিছু সংশোধনী শ্রমিকদের স্বার্থে এসেছে এবং আমরা সেগুলোর সাথে সহমত। তবে শিল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাও জরুরি, তাই এমন পরিবর্তন দরকার যেগুলো শ্রমিকের পাশাপাশি শিল্পের স্বার্থকেও বিবেচনায় নেয়। তিনি মজুরি কাঠামো সম্পর্কেও মতামত ব্যক্ত করেন, বলে তিনি যে, তিন বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণের বিষয়টি ভালো, তবে প্রতি বছর মজুরি পুনঃবিবেচনা করলে জীবনযাত্রার মান বজায় থাকবে এবং শিল্পের ওপর চাপও কমবে।
এলআরসি সদস্য তাসলিমা আখতার বলেন, শ্রমিকদের মতামত প্রায়শই বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তিন বছর পর পর মজুরি পুনঃনির্ধারণে অগ্রগতি হলেও বিদেশি ক্রেতাদের জবাবদিহিতা বিষয়টির অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সরকারের পক্ষ থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামসুল আলম বলেন, সংশোধনী প্রক্রিয়াটিতে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অবদান রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতায় এই পরিবর্তনগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে। তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো প্রয়োজনীয় আলোচনা ও বিশ্লেষণে শেয়ার করবে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইনটি অন্যান্য দেশের তুলনায় কোডিফায়েড। এই ধরনের আইনে পরিবর্তন আনা জটিল ও বিভ্রান্তিকর হতে পারে। তাই আইনের সমস্ত অংশ বিবেচনা করে সুবোধ্য বিশ্লেষণ করে অসঙ্গতি চিহ্নিত করা উচিত। তিনি আরও জানান, শ্রমশক্তির সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সব মন্তব্য ও সুপারিশ মিলে জানা যায়, সংশোধনী কার্যকর করতে একসঙ্গে পর্যালোচনা, প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অপরিহার্য। সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের শ্রম অধিকার উন্নয়নের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জোরদারকরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।

