বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের মাঝেই সিলেট অঞ্চলে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন গাঁথা তৈরি হয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই বদলে গেছে। সিলেটের ১৯টি সংসদীয় আসনে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে; বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংঘটিত হতে চলেছে, যা এই অঞ্চলের রাজনীতির চেহারা পাল্টে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছিল একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধী দলগুলো যতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক না কেন, ফলাফল আগেই নির্ধারিত থাকত বলে অনেক অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়। দমন-পীড়ন, জনবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ব্যাপক রাষ্ট্রীয় অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনী পরিবেশকে নিজের মত করে সাজানো হত। তবে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের মাধ্যমে সেই স্বৈরাচারী পরিবেশের অবসান ঘটেছে এবং বর্তমানে এক নতুন রাজনৈতিক দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় বিশ্লেষকমহল বলছে, এই সময়ে জামায়াত ইসলামী দলটি অনেকটাই শক্তিশালী ও সংগঠিত অবস্থানে ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পর তারা এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে এসে বেশ কৌশল নিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছে। যুব প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে জামায়াত নতুন পরিকল্পনা করছে, যেখানে তারা তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা বা তরুণ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে।
জামায়াতের নেতা-নেত্রীরা জানিয়েছেন, তারা জেন-জি প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করেছেন। তরুণ প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব দিয়ে নতুন ধরনের রাজনীতি গড়ে তুলতে চাই তারা। এই সিদ্ধান্তে দলের অঙ্গ সংগঠনের পাশাপাশি সাধারণ সমর্থকরাও সন্তুষ্ট রয়েছেন। তারা মনে করছেন, জামায়াত এবার নির্বাচনের মাঠে শক্তিশালী অস্তিত্ব দেখাতে সক্ষম হবে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, জামায়াত সিলেট বিভাগের ছয়টি আসনে নিশ্চিত জয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই আসনগুলো হলো সিলেট-৩, সিলেট-৪, সিলেট-৫, সুনামগঞ্জ-২, মৌলভীবাজার-১ এবং হবিগঞ্জ-১। এসব আসনে তারা নিজেদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে ও নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। তাদের অন্য কিছু আসনের জন্য সিলেট-১, সিলেট-৬ ও সুনামগঞ্জ-৫ এ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলার পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে, এসব আসনের ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করছে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন الديمقত্তের উপরে।
জামায়াতের একজন শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিএনপি যদি তাদের সিদ্ধান্তে স্থিত থাকে, তাহলে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বললেন, আমরা আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করছি এবং তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
অন্যদিকে, সিলেটে বিএনপির জনসমর্থনও প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দীর্ঘ দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। তবে, এই জনসমর্থনকে নির্বাচনী বিজয়ে রূপান্তর করতে হলে সঠিক ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিএনপির কিছু প্রার্থী দীর্ঘদিন আওয়ামী শাসনের পিছনে থাকলেও আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, এখন তারা পুনরায় আসার অপেক্ষায়।
বিশেষত, যারা একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তারাও এই নির্বাচনে পুনরায় মনোনয়নের জন্য দৌড়ে রয়েছেন। তবে, এসব প্রার্থীর মধ্যে অনেকের এলাকায় জনমত কম বা দলীয় কর্মীদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা কম বলে অভিযোগ উঠেছে।
বৈশ্বিক বৈচিত্র্য ও আধুনিক যোগাযোগের যুগে ভোটাররা অনেক বেশি সচেতন এবং তথ্যসমৃদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌলত্যে এখন প্রতিটি প্রার্থীর অতীত, রাজনৈতিক অবস্থান ও ব্যক্তিগত জীবন সহজেই জানা যায়। এই সব কারণে, এই নির্বাচনী প্রচেষ্টা আরও কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
সুতরাং, এই নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারিত করবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিএনপি ও জামায়াতের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে বিএনপি দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফলাফল পাওয়ার সুযোগ পাবে, অন্যদিকে জামায়াত তাদের নতুন করে শক্তির সঙ্গে ফিরে আসার রাস্তা তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সিলেটের এই ১৯টি আসনের ফলাফলে শুধু এই অঞ্চলের নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সমীকরণেও পরিবর্তন আসবে। এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভোটের দিন পর্যন্ত দলগুলো কিভাবে প্রস্তুতি নেবে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করবে, তার উপরই ভোটের চূড়ান্ত ফল নির্ভর করবে। তবে, এটাও স্পষ্ট যে, এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি থাকবে এবং এটি আগের ভোটের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ।

