সাম্প্রতিক ঘটনার পর সময়ের দুঃখে এবং নিরাপত্তা ও সম্মানের অভাবে আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান বাংলাদেশে আর ফিরে না আসার ঘোষণা দিয়েছেন। সংগীতপ্রিয় এই শিল্পী জানিয়েছেন, তিনি প্রথমবারের মতো ভয় পেয়েছেন, যা একটি দুঃখজনক সত্য। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে তিনি ঢাকায় থাকা সময়, ছায়ানটের ওপর হামলার কারণে গভীর উদ্বেগে পড়েছেন। ফলে, শুক্রবারের পরিকল্পিত পারফরমেন্স আর করতে পারেননি।
সিরাজ আলী খান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন, ‘দেশটা শেষ, বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে আমার কাছে, একজন শিল্পী হিসেবে।’ তিনি বলেন, ‘১৯ ডিসেম্বর আমি ঢাকার ছায়ানট প্রাঙ্গণে একটি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোরে একটি দেড়শো’র বেশি জনতা ছায়ানটের ভেতরে আক্রমণ চালায় ও ভাঙচুর করে।’
সিরাজ আলী খান তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন—তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি, তার মা ধ্যানেশ খানের ছেলে, এবং তিনি শেক সাদী খানসহ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ভারতের মাইহার ঘরানার একজন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, যেখানে তিনি থাকেন।
রংপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের স্মৃতিচারণ করে সিরাজ আলী খান বলেন, ‘সেখানে সুন্দরভাবে পারফর্ম করে প্রশংসা লাভ করেছি।’
তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘আমি এখন পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, যতদিন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত না হবে, আমি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরবো না। এটি আমার দায়িত্ববোধ ও পরিবারের উত্তরাধিকার। সংগীতের শক্তির ওপর আমি বিশ্বাস করি—এটি আরোগ্য ও ঐক্য গড়তে পারে। আশা করি একদিন বাংলাদেশে যেন আবার সংস্কৃতি ও শিল্পের জন্য সম্মান ফিরে আসে, সেই সেতুটাও পুনঃসংস্কার হবে।’
সিরাজ বলেন, ‘আমি সবসময় আমার শিকড়ের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য বাংলায় ফিরে এসেছি। আমার বড় বাবা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঐতিহ্য ও মাইহার ঘরানার উত্তরাধিকার ভাগ করে নিতে। আমি এসেছিলাম বিনয়, শ্রদ্ধা এবং সংগীতের জন্য।’
তিনি গভীর বেদনায় উল্লেখ করেন, ‘প্রথমবারের মতো বলতে হচ্ছে, আমরা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য ভীত। আগে কল্পনাও করিনি যে বাংলাদেশে একজন ভারতীয় শিল্পী হিসেবে নিজের পরিচয় প্রকাশ করলেই বিপদে পড়ব। সৌভাগ্যবশত ভারতে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছি, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
সিরাজের ভাষ্য, ‘১৮ ডিসেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুধু সেই সংগঠন বা সংগীতযন্ত্র ভাঙচুর নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক, শিল্পী ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত। সংগীত সবসময়ই দেশের ইতিহাসের সাথে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে এসেছে। এই সেতুটি যদি ভয় ও সহিংসতায় ভেঙে যায়, তাহলে আমাদের অনেক কিছু হারাতে হবে।’
ফেসবুক পোস্টে সিরাজ আলী খান লিখেছেন, ‘আমার কষ্ট মূলত সেই উন্মত্ত জনতার মানসিকতার বিরুদ্ধে, যারা সংস্কৃতি ও জ্ঞান প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালায়। সংগীত ও শিল্প রাজনীতি ও সহিংসতার ঊর্ধ্বে থাকলেও, যখন তারা আঘাতের শিকার হয়, তখন গা শিউরে উঠে।’
বাংলাদেশকে ‘পিতৃভূমি’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘আমার এই সময়ে পাওয়া সমালোচনাগুলি হতভম্ব বা অপ্রিয় নয়, বরং উদ্বেগের প্রকাশ। আমি সত্যিই আশাবাদী যে প্রজ্ঞা, সংলাপ ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মানই শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করবে, যেমনটি এই দেশের দীর্ঘ ইতিহাসে বারবার ঘটেছে।’
সিরাজ আলী খান তার ফেসবুক স্টেটে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমিকে ট্যাগ করে বলেন, ‘এই পোস্টটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এটি বিশেষ করে সেই শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের জন্য, যারা আমাকে সবসময় সম্মান ও ভালোবাসা দিয়েছেন। ঢাকায় অতীতের মতো উষ্ণতা ও ভালোবাসা পেয়েছি—বিশেষত একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার স্মৃতি আমি কখনোই ভুলবো না।’
আজকের খবর/আলে।

