শিল্পী, সংগীত ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে আর ফিরে আসবেন না বলে ঘোষণা দিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান। এই সিদ্ধান্তে তিনি ব্যক্ত করেছেন, তিনি প্রথমবারের মতো ভয় পেয়েছেন একজন শিল্পী হিসেবে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা পৌঁছেছিলেন তিনি; কিন্তু পরের দিন, বৃহস্পতিবার, ছায়ানট সংগঠনে হামলা হয় এবং শুক্রবার তার পারফর্মের মূল অনুষ্ঠানও বাতিল হতে বাধ্য হয়।
রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানান সিরাজ আলী খান। তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে এখন দেশটা, বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে, একজন শিল্পী হিসেবে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আমার একটি অনুষ্ঠান থাকলেও, ভোরে একদল দুর্বৃত্ত ছায়ানট প্রাঙ্গণে আক্রমণ চালিয়ে ভাঙচুর করে। এজন্য অনুষ্ঠান বাতিল করতে হল।’
সিরাজ আলী খান আরো উল্লেখ করেছেন, তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে আলী আকবর খান এবং নিখিলকালের খ্যাতিমান সুরকার ও স্যান্ডমেন্টালিস্ট শেখ সাদী খানের নাতী। বর্তমানে ভারতে থাকলেও তিনি বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে গভীরভাবে যুক্ত।
তিনি জানান, ৮ অক্টোবর ঢাকার লালবাগ কেল্লায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের জন্য এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, যেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসিত হন।
শনिवारের পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই যে, যতক্ষণ না শিল্প, সংগীত ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ এবং সম্মানিত হয়, ততক্ষণ আমি বাংলাদেশে ফিরব না।’ এরপর তিনি উল্লেখ করেছেন, এই সিদ্ধান্ত রাগ বা ক্ষোভের মূল নয়, বরং ‘দায়িত্ববোধ’ থেকে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের ঐতিহ্য, আমি আগের মতোই বিশ্বাস করি, সংগীতের মধ্যে আছে সবার জন্য বোঝাপড়া ও শক্তির উৎস। আমি আশা করি, একদিন সম্পর্ক, সম্মান ও সৌহার্দ্য আবার ফিরবে, সংগীতের জন্য নতুন সেতু গড়ে উঠবে।
সিরাজ আলী খান নিজে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সংগীতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তার বড় দাদার নাম ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’, তার সন্তান ধ্যানেশ খানের নাতি তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন, সংগীত মানুষের হৃদয়কে একত্রিত করে, যা কোনও সহিংসতা বা আক্রমণ দিয়ে ভাঙা যায় না।
তিনি আরো জানান, ‘প্রথমবারের মতো অনুভব করেছি, আমরা আমাদের জীবনের জন্য প্রকৃতপক্ষে ভয় পেয়েছি। ভাবতেই পারছি না, একজন ভারতীয় শিল্পী হিসেবে আমার নিজস্ব পরিচয় বলাই আমাকে বিপদে ফেলতে পারে। গত ১৯ ডিসেম্বরের যে ঘটেছিল তা শুধুমাত্র সংগীত বা সংগঠনের ওপর আঘাত নয়, এটি সার্বজনীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর আঘাত। সংগীত এবং শিল্প সবসময়ই আমাদের দেশের ইতিহাসের অংশ, এবং যখন তা হয় সহিংসতা ও ভাঙচুরের শিকার, তখন আমাদের হারাতে হয় অনেক কিছু।’
ফেসবুকের মাধ্যমে একান্তই প্রকাশিত এই ক্ষোভে তিনি বলেন, ‘আমার একটাই দুঃখ — বিভ্রান্ত জনতার মনে মানসিকতার জন্য যারা সংস্কৃতি ও জ্ঞানের বিরোধী আক্রমণ চালায়। সংগীত ও শিল্প সবসময়ই রাজনীতি ও সহিংসতার বাইরে, আর যখন তা আঘাত বা আক্রমণের শিকার হয়, সেটা গভীর ব্যথার সৃষ্টি করে।’
বাংলাদেশকে তিনি ‘পিতৃভূমি’ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই সব প্রতিকূলতা ও উদ্বেগ থেকে উঠে আসা সমালোচনা কোনো প্রত্যাখ্যান নয়, বরং প্রতিফলন সত্যের। আমি বিশ্বাস করি, প্রজ্ঞা, সংলাপ এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মান বারবার এই মাটিতে জয়ী হয়েছে। একদিন আবার আমাদের সমাজে সেই শান্তি ও সংহতি ফিরবে।’
সিরাজ আলী খান তার সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ—সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমিকে ট্যাগ করে লিখেছেন, ‘এটি আমার কোনও বিদ্বেষ বা দোষারোপ নয়। আমি মানবিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা দিতে চাই। ঢাকায় আমার অনুভূতি ছিল অসীম উষ্ণ ও প্রেমময়, বিশেষ করে এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্মৃতি আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’

