আজ মোনাজাতউদ্দিন বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নামের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন শুধু একজন সাংবাদিকই নন, বরং নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান, গবেষণার বিষয়। টেবিল-চেয়ারে বসে থাকা নাগরিক সাংবাদিকতার বিপরীতে, তিনি ছিলেন তৃণমূলের খেটে খাওয়া মানুষের সংবাদকর্মী, সাধারণ মানুষের মুখপাত্র। আজও হাজারো সাংবাদিকের জন্য তিনি প্রেরণার বাতিঘর।
মোনাজাত উদ্দিনের সাংবাদিকতা ছিল আটপৌরে জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। খবরের অন্তরাল থেকে সত্যের সন্ধান করে রিপোর্ট করে তিনি সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। গ্রামগঞ্জের মেঠো পথে হাঁটা, সাধারণ মানুষের গল্প লিপিবদ্ধ করা তার জীবনের প্রতিদিনের অংশ। এর মাধ্যমে তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের সুখ-দু:খের গল্প তুলে ধরতেন, যা মন ছুঁয়ে যায়। তাঁর রিপোর্টে ছিল গভীর মানবতা ও সত্যের খোঁজ।
১৯৪৫ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন এই বিশিষ্ট সাংবাদিক। ষাটের দশকে বগুড়ার একটি ছোট সংবাদপত্র বুলেটিনে প্রথম সাংবাদিকতা অধ্যয়ন করেন তিনি। ঢাকা শহরে তিনি কাজ করেছেন দৈনিক আওয়াজ, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ ও সর্বশেষ দৈনিক জনকণ্ঠে। পাশাপাশি ছিলেন দৈনিক রংপুর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁর শিল্পের কেন্দ্র ছিল বাংলার প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনপদ। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। এসব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছেন মোট ১১টি বই।
সাংবাদিকতার জন্য তিনি পেয়েছেন নানা স্বীকৃতি, যার মধ্যে ১৯৯৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক অন্যতম। এছাড়া ফিলিপস পুরস্কার, রংপুর নাট্য সমিতির সংবর্ধনা, জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকার সম্মাননা, ফটোগ্রাফিক সোসাইটির স্বীকৃতি, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার ও অশোকা ফেলোশিপ উল্লেখযোগ্য। তবে তিনি সব পুরস্কার থেকে বড় মনে করতেন মানুষের স্নেহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে, যা জীবনে তিনি অধিক মূল্যবান মনে করতেন।
আজকের দিনের সাংবাদিকতায় মোনাজাতউদ্দিনের মতো সাহসী ও সংগ্রামী মানুষের অভাব অনুভব করা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সোহাগ আরেফিন বলেন, আমাদের দেশে মফস্বল সাংবাদিকতা চরম অবক্ষয়ে পড়েছে। মফস্বলের সাংবাদিকরা মাঝে মাঝে অবহেলিত, তাদের ব্যাপারে অনেকেরই কম আগ্রহ। কিন্তু মোনাজাতউদ্দিনের মতো একজন সংগ্রামী সাংবাদিক এই মানসিকতা বদলের প্রেরণা। তিনি যে সাহস এবং মানবতাপ্রেমের জন্য পরিচিত, তা আজও আমাদের জন্য অনুপম উদাহরণ।
সিআরএ’র সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খোকন বলেন, বর্তমানে দেশের সাংবাদিকতা কঠিন সময় পার করছে। এই কঠিন অবস্থায় মোনাজাতউদ্দিনের মতো মানুষের অবদান যুবসমাজকে সচেতন করে তুলতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ তরুণ সাংবাদিকই এই ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। সবখানে সাংবাদিকতার অবনতি ঘটছে, ব্যবসা-তোষ খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানে।
মোনাজাতউদ্দিনের জীবন আর অবদান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দেশের সাধারণ মানুষের কথা বলার মাধ্যমে সত্যের সন্ধান এবং সমাজের উন্নয়নে যে কাজগুলো করা যায়। আজ তার ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই, ও অব্যাহত শুভকামনা ও সংহতি প্রকাশ করি।

