বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক এবং সংগীতমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনই নিরাপদ না হলে আর কখনোই ফিরবেন না বলে ঘোষণা দিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান। সেই সঙ্গে তিনি জানান, এই সিদ্ধান্ত তিনি শুধু রাগ বা অসন্তোষের কারণেই নেননি, বরং দায়িত্ববোধ ও পরিবারের উত্তরাধিকার রক্ষা করার জন্য। তরুণ এই শিল্পী বলেন, তিনি এখনও বিশ্বাস করেন সংগীতের শক্তি আছে একাত্মতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার khảতায়।
সিরাজ আলী খান জানান, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে তিনি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে ১৬৩তম জন্মবার্ষিকীতে তার পারফরম্যান্সের কথা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ছায়ানট প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় তিনি গভীর উদ্বগ্রস্ত হন। তিনি আরও বলেন, রবিবার এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘দেশটা শেষ, বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে আমার কাছে, একজন শিল্পী হিসেবে।’ এই হামলার ঘটনাকে দেশের সংস্কৃতি, শিল্পী ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
সিরাজ আলী খান জানান, তিনি ভারতের মাইহার ঘরানার একজন খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী, এবং তার পরিবারে সংগীতের ঐতিহ্য অনেক পুরনো। তার বাবার স্বচ্ছন্দ্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, তার সন্তান ধ্যানেশ খান, এবং নিজে বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছেন। গর্বের সাথে তিনি বলেন, গত অক্টোবরে ঢাকায় লালবাগ কেল্লায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি দেশের সংগীতপ্রেমীদের সামনে এসেছেন এবং পেয়েছেন অসীম সম্মান।
তবে এই ঘটনার পর নিজেকে আরও জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এখন আর বাংলাদেশে ফিরে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই দেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ হয়।’ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তার এই সিদ্ধান্ত প্রহসনের জন্য নয়, বরং তার দায়িত্ববোধ, পরিবারের উত্তরাধিকার, এবং নিজের নিরাপত্তার জন্য। তিনি আশা প্রকাশ করেন, একদিন এই দেশের সংগীত এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ আবারও পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
সিরাজ আলী খান জানান, তিনি তার শেকড়ের সঙ্গে নতুন করে সংযুক্ত হতে চান এবং তার পরিবারের ঐতিহ্য ও সংগীতের উত্তরাধিকার ভাগ করে নিতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সংগীত, বিনয় ও শ্রদ্ধা নিয়ে এসেছি।’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আগে কখনো ভাবিনি যে আমি বাংলাদেশের একজন ভারতীয় শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে নিজের বিপদে পড়বো। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি নিরাপদে ভারতে ফিরে আসতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘১৯ ডিসেম্বরের ঘটনার মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক গভীর আঘাত লেগেছে। সংগীত ও সংস্কৃতি সবসময়ই আমাদের দেশের ঐতিহ্যের মূল স্তম্ভ ছিল। এই ঘটনার মাধ্যমে সেই সেতুটি ভেঙে গেছে, যা আমাদের হারানোর আরও অনেক কিছু বুঝিয়েছে।’
ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র দুঃখ সেই উন্মত্ত জনতার মানসিকতা নিয়ে, যারা সংস্কৃতি ও জ্ঞানমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। সংগীত সবসময় রাজনীতি ও সহিংসতার ঊর্ধ্বে থাকলেও, যখন তা আঘাতের শিকার হয়, তখন আমাদের গভীর কষ্ট হয়।’
সিরাজ আলী খান বাংলাদেশকে ‘পিতৃভূমি’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে তৈরি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনা কোনওভাবে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং তা একটি উদ্বেগের প্রকাশ। তিনি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলেন, ‘প্রজ্ঞা, সংলাপ, এবং সংস্কৃতি সম্মান থেকেই শেষ পর্যন্ত সত্যিকার উন্নতি হবে। এই জাতির ইতিহাস বারবার বলা হয়েছে, ঐতিহ্য আরও দৃঢ় হয় যখন দেশ সংকটে রয়েছে।’
সিরাজ আলী খান তার পোস্টে জাতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমিকে তালিকাভুক্ত করে লিখেছেন, ‘এটা আমার সরকারের বিরুদ্ধে নয়। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা সবসময় আমাকে সম্মান ও ভালোবাসা দিয়েছেন। আমি সেই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের অংশ হতে পেরে গর্বিত, যেখানে আমি এক সময় আমার পরিবারের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্য ভাগ করে নিয়েছি।’

