২৪ অক্টোবর ২০১৩। পোর্টাল বাংলাদেশ ডেস্ক।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি বছর শেষে এ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দেন বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইউহানেস জাট। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইউহানেস জাট চলমান রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেন। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক।
ইউহানেস জাট বলেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে বলে আশা করেন তিনি। অক্টোবর পর্যন্ত অর্থনীতির সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত সমন্বয় করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, তা অর্জিত হবে না। সরকার আশা করছে, এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৭.২ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বছর শেষে এ হার হবে ৫.৭ শতাংশ। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণেও প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি গতবারের মতো এবারও কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে পাঁচটি ঝুঁকি রয়েছে। এগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমবে, রাজস্ব নীতি বান্তবায়ন কঠিন হবে, পোশাক রপ্তানি কমবে এবং আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হবে। আগামী দিনগুলোতে এই পাঁচটি ঝুঁকি শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি বর্তমানে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও আগামীতে তা থাকবে না। অভ্যন্তরীণ কারণেই এই হার বেড়ে যাবে। তিনি আশঙ্কা করেন, আগামীতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শহরাঞ্চলের মানুষ। ড. জাহিদের মতে, নির্বাচনের বছর হওয়ায় ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত কর আদায় সম্ভব হবে না। এরই মধ্যে সরকারের জনতুষ্টিমূলক খরচ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, জনশক্তি রপ্তানিও কমে গেছে, যে কারণে জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এর সঙ্গে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব তো রয়েছেই। তবে সবচেয়ে বড় সংকট হলো পোশাক শিল্পে ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনা। এটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। পোশাক শিল্পকে টেকসই করতে হবে। এই খাত থেকে যে সাফল্য এসেছে, তা ধরে রাখা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
ড. জাহিদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু দুঃসংবাদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো- আশঙ্কাজনকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার ১.২ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের বিনিয়োগের হার আগে কখনো কমেনি। এটাই প্রথম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পোশাক শিল্পে অসন্তোষ, কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যর্থতা, ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারি, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ঘাটতি ঘটিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশে তেমন উন্নতি হয়নি। এ দেশে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে দুর্বল অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, দুর্নীতি এবং অদক্ষ প্রশাসনই প্রধান প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশকে দ্রুত এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি কমেছে ঠিকই, কিন্তু মূল্য কমেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করায় খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত তথা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
ড. জাহিদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলে রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। ইইউ যদি জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে, তাহলে মোট রপ্তানির ৪ থেকে ৮ শতাংশ কমে যাবে। আগামী বছর জুনে ইইউ প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরের আগেই পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, মজুরি এবং শ্রম আইন বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ভারতে ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন হওয়ায় বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করেন ড. জাহিদ।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশে বর্তমানে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, তা সন্তোষজনক। এটিকে অতিরিক্ত বলা যাবে না বলে জানান তিনি। তবে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলে তখন অতিরিক্ত বলা যাবে। বর্তমানে ৪.৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯৭-৯৮ সালে এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ানো শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আগে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ মজুদ থাকলেই চলত। আন্তর্জাতিকভাবে এখন এটা বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। প্রতিবেদনের শেষ ভাগে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে ব্যাংকিং খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক। সংস্কারের গতি অত্যন্ত শ্লথ বলেও অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বিশেষ করে ভ্যাট আইন, ব্যাংক কম্পানি আইন, অনলাইন ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি, শ্রম আইন, থ্রিজি লাইসেন্স প্রদান যত দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
ড. জাহিদ বলেন, দেশের গত চারটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্বাচনের বছর অর্থনীতির অনেক সূচক ধারাবাহিক অবস্থান ধরে রাখতে পারে না।