সবুজ গালিচায় বল গড়ানোর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ফুটবল বিশ্ব। নেইমার-মেসি-রোনালদো-গ্রিজম্যান-সুয়ারেজ-সালাহ-কাভানিরা মাতাবেন রাশিয়া বিশ্বকাপ। গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সঙ্গে পুরো বিশ্ব ফুটবল দেখবে তাদের পায়ের জাদু। দুই দল, ২২ খেলোয়াড় আর তিন রেফারির পাশাপাশি ক্যামেরার চোখ দিয়ে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের নজর দুলতে থাকবে একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে, সেটি বিশ্বকাপের বল। এক নজরে জেনে নেওয়া যাক সেই বলের কিছু খুঁটিনাটি৷
উন্নত ফুটবল তৈরির জন্য যুগের পর যুগ গবেষণা হয়েছে, যা এখনও বিদ্যমান। সেই ১৯৩০ সালের উরুগুয়ে বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে আসন্ন রাশিয়া বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে ফুটবল। ভিন্ন নামে, কিছুটা আধুনিক হয়ে খেলার আরও উপযোগী করে তোলা হয়েছে এই ফুটবলকে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের অফিসিয়াল বলের নাম টেলস্টার-১৮৷ ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হয়েছিল ব্রাজুকা। ব্রাজুকার মতো টেলস্টার তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে অবস্থিত ফরোয়ার্ড স্পোর্টসে। বিশ্ব খ্যাত অ্যাডিডাসের হয়ে বল তৈরিতে কাজ করেছে ফরোয়ার্ড স্পোর্টস।
ফুটবল তৈরির বিষয়টি উঠলেই সবার আগে আসে অ্যাডিডাসের নাম। ১৯৬৩ সাল থেকে ফুটবল তৈরি করে আসছে ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারী এই জার্মান কোম্পানিটি। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের নবম আসরে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফার সঙ্গে প্রথমবারের মতো বল তৈরির ব্যাপারে চুক্তি করে অ্যাডিডাস। ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বকাপের জন্য বল তৈরি করছে তারা, যা আজ অবধি চলছে।
রাশিয়া বিশ্বকাপেও খেলা হবে অ্যাডিডাসের তৈরি বলেই। বলা চলে, সাদা-কালো যুগের বলকে রঙিন দুনিয়ায় নতুন করে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে খেলাধুলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী বিশ্বের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস।
১৯৭০ বিশ্বকাপের বল টেলস্টার থেকে কিছুটা বিবর্তন হয়ে এবারের বিশ্বকাপের বলের নকশা করা হয়েছে। সেদিক থেকে চলতি বছর টেলস্টারের ৪৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৭৪ বিশ্বকাপেও ছিল ওই বল। সেই ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপের বলের নাম ছিল তিয়েন্তো। সেখান থেকে বিবর্তনের পথ ধরে বলের নাম হয়েছে টেলস্টার। ১৯৬২ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডায় টেলস্টার নামের একটি স্যাটেলাইট স্টেশন চালু হয়। যেটি আবহাওয়া ও টর্নেডোর পূর্বাভাস সম্প্রাচার করতো। জনপ্রিয় সেই নাম থেকেই টেলস্টার নামটি ধার করে বিশ্বকাপ বলের নাম দেওয়া হয় টেলস্টার। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্যবহার করা বলে অনুপ্রাণিত হয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য টেলস্টার-১৮ তৈরি করা হয়েছে। ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা হয়েছিল টেলস্টার বলে। সেই সময় পেলে এবং বেকেনবাওয়ারের মতো কিংবদন্তিরা এই বল দিয়ে খেলেছিলেন।
এছাড়া, ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবার ব্যবহার করা হয়েছিল টেলস্টার। সেদিক দিয়ে ২০১৮ সালে এই বল তৈরির ৫০ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ প্রথম টেলিভিশনের পর্দায় সম্প্রচারিত বিশ্বকাপ। সে সময় সাদা-কালো টেলিভিশনে খেলা দেখতে যাতে সুবিধা হয়, সেই জন্য টেলস্টার বল দিয়ে খেলা চালানো হয়েছিল। কারণ, এতে ছিল ১২টি কালো প্যানেল আর বাকিগুলো ছিল সাদা। ‘টেলস্টার’ নামটিও এসেছে মূলত ‘টেলিভিশন’ এবং ‘স্টার’ শব্দ দুটি থেকে। তখন বলটির আরেক নামকরণ করা হয়েছিল ‘স্টার অব টেলিভিশন’। ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল টেলস্টার বল।
বিশ্বকাপের বলের নাম ও ডিজাইনে সাধারণত আয়োজক দেশের ঐতিহ্যের ছাপ থাকে। যে ধারায় ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ‘জাবুলানি’ এবং ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ‘ব্রাজুকা’ তৈরি করা হয়েছিল। তবে এবার আর সে পথে হাঁটেনি অ্যাডিডাস। মূলত টেলস্টার তৈরির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই বলকেই বেছে নিয়েছে অ্যাডিডাস। আধুনিকতা আর প্রযুক্তির প্রতীক হিসেবে এবার বলটির কালো প্যানেলে যুক্ত হয়েছে পিক্সেল।
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপে খেলা হয়েছিল ‘টি-মডেল’ নামের বল দিয়ে। যেগুলো তৈরি করেছিল ইংল্যান্ড। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা এবং স্বাগতিক উরুগুয়ে। বিরতির আগে-পরে দুই ধাপে দুই দেশের সরবরাহকৃত বল দিয়ে খেলাটি চালানো হয়েছিল। ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে খেলা হয়েছিল ইতালির তৈরি বল দিয়ে। সেবার ‘ফেডারেল ১০২’ নামে ১৩টি প্যানেলের বল সরবরাহ করেছিল ইতালি। ১৯৩৮ সালে ফ্রান্সে তৈরি ‘অ্যালেন’ বল দিয়ে টুর্নামেন্ট চলেছিল। ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলা হয়েছিল ডুলপোট বল দিয়ে। প্রথম দিকের বলগুলোতে ছিল ১২ থেকে ১৩টি প্যানেল। ১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৮ প্যানেলের বল।
বিশ্বকাপের বল:
১৯৩০ উরুগুয়ে, টি মডেল
১৯৩৪ ইতালি, ফেডারেল ১০২
১৯৩৮ ফ্রান্স, অ্যালেন
১৯৪২ এবং ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ হয়নি
১৯৫০ ব্রাজিল, ডুলপোট
১৯৫৪ সুইজারল্যান্ড, সুইস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন
১৯৫৮ সুইডেন, টপ স্টার
১৯৬২ চিলি, ক্র্যাক
১৯৬৬ ইংল্যান্ড, স্লেজেঙ্গার চ্যালেঞ্জ
১৯৭০ মেক্সিকো, টেলস্টার
১৯৭৪ জার্মানি, টেলস্টার ডারলেস্ট
১৯৭৮ আর্জেন্টিনা, টাঙ্গো ডারলেস্ট
১৯৮২ স্পেন, টাঙ্গো স্পানা
১৯৮৬ মেক্সিকো, আজট্যাকা
১৯৯০ ইতালি, এতরুসকো উইনিকো
১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র, কুইস্ট্রা
১৯৯৮ ফ্রান্স, ট্রিকোলোর
২০০২ দক্ষিণ কোরিয়া/জাপান, ফেভারনোভা
২০০৬ জার্মানি, টিমগেইস্ট
২০১০ দক্ষিন আফ্রিকা, জাবুলানি
২০১৪ ব্রাজিল, ব্রাজুকা
২০১৮ রাশিয়া, টেলস্টার-১৮
ইতোমধ্যেই এই বল মাঠে গড়ানোর আগে তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসির প্রশংসা পেয়েছে টেলস্টার-১৮। আকারে ছোট ও হালকা এই বল নিয়ে সমালোচনাও কম নেই। স্পেনের গোলরক্ষক পেপে রেইনা, ডি গিয়া, জার্মানির গোলরক্ষক টার স্টেগেন এই বলের সমালোচনা করেছেন। আরও অনেক গোলরক্ষকের মতে, ডি বক্সের অনেক দূর থেকেই এই বল দিয়ে গোল করা সম্ভব। বাতাসে বলের গতি বেশ অনেকখানি পরিবর্তন হয়। রাশিয়ায় গোলরক্ষকদের জন্য টেলস্টার হতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ‘বখাটে ছেলে‘র মতো। তবে, এর আগেও বল নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন গোলরক্ষকরা। ২০০২ বিশ্বকাপে ইতালির গোলরক্ষক এবং অধিনায়ক জিয়ানলুইজি বুফন বিশ্বকাপের বলকে বলেছিলেন, ‘হাস্যকর কিডস’। ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াস বলেছিলেন,‘বিচ বল।’ রাশিয়া বিশ্বকাপ শেষে টেলস্টার-১৮ এর ভাগ্যে কি নাম জুটতে যাচ্ছে সেটা সময় হলেই শোনা যাবে।