ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ধারাবাহিকতায় এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত হলো। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রবিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করার আদেশ দেন। এর পরপর নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ রাখতে গাজীপুরের সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছে।
নির্বাচন স্থগিত হওয়ার খবর গাজীপুরে পৌঁছলে প্রার্থী ও কর্মীরা স্তব্ধ হয়ে যান। বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁরা আইনি লড়াই লড়বেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম প্রচারণা স্থগিত রেখে সোজা ঢাকায় চলে যান। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশলে নির্বাচন স্থগিত করে সরকার ও আমাদের বিব্রত করেছে। আমরা এ আদেশের ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গতকাল খুশিমনেই নগরীর ছয়দানার হারিকেন এলাকার প্রীতি সোয়েটার কারখানায় প্রচারণা চালাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর মিডিয়া সেলের সদস্য এস এম আলম বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে তাঁকে খবরটি জানালে বিমর্ষ হয়ে যান তিনি। বিএনপির মেয়র প্রার্থী খবর জানতে পারেন আরো পাঁচ মিনিট পর। ওই সময় তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ গাজীপুরের নেতাদের নিয়ে টঙ্গীর মিরাশপাড়া এলাকায় গণসংযোগ করছিলেন।
পরে হাসান উদ্দিন তাঁর বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘১৫ তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে আমরা আবেদন করব। জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনব।’ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের মেয়ার প্রার্থী নিশ্চিত হারবেন বলেও তিনি দাবি করেন।
তবে সংবাদ সম্মেলন শেষ হতে না হতেই হাসান সরকারের বাসা ঘিরে ফেলে পুলিশ। রাত ৮টা পর্যন্ত পুলিশ সেখানে অবস্থান করে রাস্তার উল্টো পাশে সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তাঁর বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ নেতাকর্মীকে আটক করে টঙ্গী থানার পুলিশ। পরে রাতে নোমানকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে বলে জানা যায়।
গাজীপুর আদালতের জিপি আমজাদ হোসেন বাবুলের কক্ষে বসে নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী আলাপ-আলোচনা করার সময় নির্বাচন স্থগিতের খবর জানতে পারেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমতউল্লা খান। মুহৃর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় সরগরম কক্ষ। নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনে কয়েক দফা কথা বলে হতাশ মুখে তিনি গাড়িতে করে টঙ্গীর দিকে রওনা হন। এ সময় তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘না জেনে উচ্চ আদালতের বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
যে মুহূর্তে নির্বাচন স্থগিতের খবর আসে, তখন গাজীপুর আদালত প্রাঙ্গণের ১ নম্বর হলরুম এলাকায় বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের জন্য লিফলেট বিতরণের মাধমে ভোট চাইছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। নির্বাচন স্থগিতের খবর শুনে তিনিও প্রথমে হতবাক, পরে বিষণ্ন মনে ফিরে আসেন শহরের রাজবাড়ী সড়কের জেলা বিএনপি কার্যালয়ে।
স্থগিতের নেপথ্যে : হাইকোর্ট একই সঙ্গে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে সরকারের জারি করা দুটি প্রজ্ঞাপন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়েছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য ঘোষিত তফসিল কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। তফসিল অনুযায়ী ১৫ মে এই নির্বাচন।
শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের রিট আবেদনে এ আদেশ আসে। ঢাকার সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বাড়ৈবাড়ী, ডোমনা, শিবরামপুর (আংশিক), পশ্চিম পানিশাইল (আংশিক), পানিশাইল (আংশিক) ও ডোমনাগ—এই ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটিতে নেওয়ার বৈধতা নিয়ে এ রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন বি এম ইলিয়াছ কচি ও সৈয়দ মো. রেজাউর রহমান এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের আদেশ না দেখে এখনই সিদ্ধান্ত বলা যাবে না আপিল করা হবে কি না। ইসির আইনজীবী জানান, আদেশের তথ্য ইসিকে জানানো হয়েছে। ইসি যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২০১২ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয় এবং পরের বছর ঢাকার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজাকে গাজীপুর সিটির অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে সুরুজ স্থানীয় সরকার বিভাগে আবেদন করেন। সিদ্ধান্ত না পেয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করেন সুরুজ। আদালত রুলে ওই ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চান। পরে শুনানি শেষে আদালত ২০১৭ সালে এলাকাটি গাজীপুর রাখারই নির্দেশ দেন। তবে এর আগেই ২০১৬ সালে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সুরুজ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গেছেন। হাইকোর্টের গত বছরের নির্দেশের পর স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ৪ মার্চ মৌজা ছয়টিকে গাজীপুরের অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে এবং নির্বাচন কমিশন ৩ এপ্রিল তফসিল ঘোষণা করে। ১০ এপ্রিল ফের রিট করেন সুরুজ। রিট আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে শুনানির পর তা খারিজ করেন আদালত। গতকাল সুরুজ আবারও রিট আবেদন করার পর আদালতে শুনানির জন্য উত্থাপিত হলে আদালত ইসির আইনজীবীকে ডেকে পাঠান। শুনানি শেষে আদালত তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করেন। স্থানীয় সরকার সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, স্থানীয় সরকার বিভাগের (সিটি করপোরেশন-২) উপসচিব, ঢাকা ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক, নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব (চলতি দায়িত্ব) ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রিট আবেদনে সুরুজ যুক্তি দেখান, এক জেলার এলাকা অন্য জেলাভুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নিয়ম মানা হয়নি, ঢাকা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়নি, গাজীপুর সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়েও ঢাকা জেলা প্রশাসন অবহিত নয়। এ ছাড়া ছয় মৌজা গাজীপুর সিটিতে নেওয়ায় এলাকার মানুষ দ্বৈত এলাকার নাগরিক হয়ে গেছে। ছয় মৌজার নাগরিকদের সিটি করপোরেশনের ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি বলেও জানান সুরুজ।
গাজীপুর জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা চলছিল। নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ভোটার, নগরীর বাসিন্দা ও প্রার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।