দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আইএস নেতা হওয়ার ‘স্বপ্ন দেখেন’ যিনি
সাত বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার ছোট্ট শহর সোলোর শান্ত জীবনে চুপচাপ একটি ইন্টারনেট ক্যাফে চালাতেন বাহরুন নাইম। জাকার্তায় জঙ্গি হামলার পর হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে চলে এসেছে তার নাম।
বৃহস্পতিবার সকালে জাকার্তার কেন্দ্রস্থলে বোমা ফাটিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মঘাতী এই হামলায় নিহত হয়েছেন পাঁচ হামলাকারীসহ সাতজন।মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি দল ইসলামিক স্টেট এর দায় স্বীকার করেছে বলে ইতোমধ্যে খবর এসেছে।
পুলিশ বলছে, এই হামলা পরিকল্পনার পেছনে মূল ব্যক্তি হলেন সেই বাহরুন নাইম। তিনি এখন আছেন সিরিয়ায় আইএস এর কথিত রাজধানী রাকায়; সেখান থেকেই তিনি হামলার ছক সাজিয়েছেন।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১০ সালে অবৈধ অস্ত্রসহ ধরা পড়লে তিন বছরের জেল হয় নাইমের। সাজা খাটা শেষে বছরখানেক আগে তিনি ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে সিরিয়া গিয়ে আইএসের মূল দলে যোগ দেন বলে ধারণা করা হয়।
জাকার্তা পোস্ট লিখেছে, সিরি লেসতারি নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পর গতবছর নাইমের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। শোনা যায়, ২০১৪ সালে নাইমকে বিয়ে করেছিলেন লেসতারি।
এর পর থেকে নাইমের বিষয়ে নানা তথ্য পেতে শুরু করে পুলিশ। জানা যায়, ইস্ট ইন্দোনেশিয়া মুজাহিদিন গ্রুপের নেতা আবু ওয়ারদা সান্তোষোর সঙ্গে নাইমের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সোলো আর জাভা এলাকায় গত কয়েকবছর ধরে গড়ে ওঠা জঙ্গি চক্রের মূল সংগঠক এই নাইম। জাকার্তা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবেও তাকেই পুলিশের সন্দেহ।
রয়টার্স লিখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া গত বছরখানেক ধরেই জঙ্গি হামলার হুমকি পেয়ে আসছিল। খিলাফত কায়েমের নামে ব্যাপক হত্যা-সন্ত্রাস চালিয়ে আসা আইএস ইন্দোনেশিয়াকেই তাদের এশিয়ায় অবতরণের প্রথম বন্দর বানাতে চায়।
গত নভেম্বরে প্যারিসে একসঙ্গে কয়েকটি স্থানে সমন্বিত হামলার পর ‘জঙ্গি বুদ্ধিজীবী’ বাহরুন নাইম একটি ব্লগ লেখেন। সেখানে তিনি অনুসারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন- কীভাবে ইন্দোনেশিয়ার নিরক্ষীয় জঙ্গলের গেরিলাযুদ্ধ থেকে ‘জিহাদকে’ সহজেই শহরে নিয়ে যাওয়া যায়।
নাইমের ঘনিষ্ঠ একজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৪ নভেম্বর টেলিগ্রাম ম্যাসেঞ্জারে ইন্দোনেশিয়ার এই জঙ্গি নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। ওই কথোপকথনে নাইম বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার জন্য যথেষ্ট আইএস সমর্থক রয়েছে। তারা কেবল অপেক্ষা করছেন ‘সঠিক’ সুযোগের জন্য।
রয়টার্স জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার জাকার্তায় হামলার ঘটনার পর আবারও নাইমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তারা। তবে এবার আর তাকে পাওয়া যায়নি।
সরকারের হয়ে কাজ করেন এমন একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নভেম্বরের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে নজর রেখে গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন যে, ইন্দোনেশিয়ায় হামলা আসছে।
এরপর থেকে জাভা অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে কয়েক ডজন লোককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছে পাওয়া যায় বোমা বানানোর সরঞ্জাম, সুইসাইড ভেস্ট আর জিহাদের নির্দেশিকা। বড়দিন আর নববর্ষ সামনে রেখে তারা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়।
সে সময় গ্রেপ্তারদের মধ্যে কয়েকজন নাইমের কাছ থেকে অর্থ ও সহযোগিতা পেয়ে আসছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
জাকার্তার পুলিশ প্রধান টিটো কার্নাভিয়ান বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, নাইম বেশ কিছুদিন ধরেই হামলার পরিকল্পনা করছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আইএস এর নেতা হওয়ার ‘বাসনা’ রয়েছে তার।
প্যারিস হামলার পর লেখা সেই ব্লগে নাইম তার অনুসারীদের ওই ঘটনা থেকে শিখতে বলেন। ‘প্যারিস জিহাদের’ পরিকল্পনা, নিশানা, টাইমিং, সমন্বয়, নিরাপত্তা ও সাহসিকতার দিকগুলো ভালভাবে বুঝে নিতে বলেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, প্যারিস হামলার ধরন অনুসরণ করে জাকার্তার ঘটনা ঘটানো হলেও হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে হামলাকারীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে।
বিবিসি লিখেছে, একসময় কম্পিউটার টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন নাইম। ধারণা করা হয়, তার বাড়ি সেন্ট্রাল জাভার পেকালংগানে।
নাইমের নামে প্রকাশিত একটি ব্লগে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে, যিনি রাজনীতি, নিরাপত্তা ও বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করেন। ‘অ্যাবাউট’ অংশে বলা হয়েছে, তার জন্ম ১৯৮৩ সালে।
নভেম্বরে টেলিগ্রাম ম্যাসেঞ্জারের আলাপে নাইম রয়টার্সকে বলেছিলেন, সিরিয়ার জীবন তিনি উপভোগ করছেন। দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা তার আপাতত নেই।
“আমাদের আমির যদি বলেন, তিনি যেখানে যেতে বলবেন সেখানেই আমি যাব। সিরিয়ায় আমি ভাল আছি। এখানে বিদ্যুৎ আছে, থাকার জায়গা আছে, পানি আছে এবং এসবের জন্য কোনো খরচ লাগে না। এখানে যে সেবা পাচ্ছি তার মান ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে ভাল, দামেও সস্তা।