১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারের সময়ে জারি করা ‘দ্য মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স’টি (মোটরযান অধ্যাদেশ) আদালতের নির্দেশে পরিবর্তন করে সড়ক পরিবহন আইন নামে পাস করতে যাচ্ছে সরকার। বুধবার আইনটির ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আইনটি আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদের একটি সূত্র। নতুন পরিবহন আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাসের বাধ্যবাধকতা এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও নতুন আইনে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
যা আছে নতুন আইনে
১) আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও শর্ত ছিল না। নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালককে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে।
২) চালকের সহকারীর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া থাকতে হবে। সহকারী হতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্স নিতে হবে। ১৯৮৩ অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের কথা থাকলেও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত ছিল না।
৩) গাড়ি চালনার জন্য চালকের বয়স আগের মতোই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আর পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর।
৪) নতুন আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে। আগের আইনে এই ধরনের অপরাধের জন্য তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।
৫) চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনের খসড়ায়।
৬) নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এ আইন অমান্য করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৭) নতুন আইনের খসড়ায় ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে এমন অপরাধে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালকদের গ্রেফতার করতে পারবে।
৮) চালকরা যাতে আইন মেনে চলেন, সেজন্য প্রস্তাবিত আইনে পয়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে (চালকদের) পয়েন্ট কাটার সিস্টেম আছে। অর্থাৎ, ড্রাইভার যদি একবার দোষ করেন তাহলে একটা বা দুইটা পয়েন্ট কাটা হতে থাকে। এভাবে পয়েন্ট নিল (শূন্য) হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। নতুন আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে। ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধিবিধান যদি কেউ অমান্য করে তাহলে ধীরে ধীরে তার পয়েন্ট কাটা যাবে। মোট ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কোন অপরাধে কত পয়েন্ট কাটা যাবে তা আইনের তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে আর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে না। পয়েন্ট কাটা শেষে কারও লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে তাকে ডিসকোয়ালিফাই করা হবে।
মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ না করলে এক পয়েন্ট কাটা যাবে। এভাবে আরও ১১টি পয়েন্ট রয়েছে, যেগুলো অপরাধ করলে ধীরে ধীরে কাটা যাবে।
ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার দণ্ডে দণ্ডনীয় যে অপরাধ রয়েছে সেক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালককে গ্রেফতার করতে পারবে।
পেশাদার ও অপেশাদার চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হবে। যদি কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় তাহলে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আগের অধ্যাদেশে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহারের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও নতুন আইনে ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
ফিটনেস চলে যাওয়ার পরেও মোটরযানের ব্যবহার করলে এক বছরের জেল বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। এই অপরাধে আগের আইনে ছয় মাস জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতো। নতুন আইনে মোটরযানের মালিককে এই সাজা দেওয়া হবে।
দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধিতে তিন রকমের বিধান আছে। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা হবে। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী ৩ বছরের কারাদণ্ড হবে।
বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কাউকে নিহত বা আহত করলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা হবে। দুই গাড়ি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
দুর্ঘটনায় না পড়লেও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
এক্সেল বা ওজনসীমা অতিক্রম (৫ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকের চেয়ে বেশি) করলে গাড়ির মালিক ও চালককে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
মোটরযান চলাচলে সাধারণ নির্দেশাবলি নামে একটি নতুন ধারায় ২৫টি নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জম ব্যবহার করতে পারবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। সিট বেল্ট না বেঁধে গাড়ি চালানো, মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনও যাত্রী বসবেন না বা বসার অনুমতি দেওয়া যাবে না, এটা লঙ্ঘন করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মহিলাদের সিটে বসতে না দিয়ে যদি অন্য কেউ (পুরুষ যাত্রী) বসে যায় তার জন্য এক মাসের জেল বা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
মদ পান করে বা নেশাজতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টোপথে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী ওঠালে, মোটরসাইকেলের চালক ও সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন করলে, সড়ক বা ফুটপাতে গাড়ি সারানোর নামে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনও মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।