রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ। বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তুত রাখা হয়েছে নতুন করে তৈরি করা ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোকে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক একটি তালিকাও মিয়ানমারের হাতে পৌঁছেছে। এই খবরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ যেতে চাইলেও অনেকেই জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, সব কিছু ঠিক থাকলে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরসহ বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ এখন উখিয়া ও টেকনাফ আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ১১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি হয়েছে গত বছরের ২৪ নভেম্বর। চুক্তির দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুই দেশের প্রস্তুতি না থাকায় প্রত্যাবাসন পিছিয়ে যায়। এরপর মিয়ানমার সরকার নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বের পাঁয়তারা শুরু করেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ চলতি মাসের আগামী সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য সম্ভাব্য দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। মিয়ানমার সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক একটি তালিকাও। এ খবরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ যেতে চাইলেও অনেকেই জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত।
উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া তিন নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোক্তার আহমদ বলেন, ‘আমরা অবশ্যই ফিরে যাবো। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা লাগবে। তা না হলে মিয়ানমার আবারও আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু করবে। কারণ মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা কঠিন।’
একই ক্যাম্পের ষাটোর্ধ বৃদ্ধ আলী হোসেন বলেন, ‘আমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। আমার দেশ মিয়ানমার। আমি মিয়ানমারে মরতে চাই। ছোটকাল থেকে নির্যাতন সহ্য করে এসেছি। না হয় আবারও নির্যাতন করবে মিয়ানমার। তারপরও আমার দেশে চলার যাওয়ার ব্যবস্থাটুকু করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাই।’
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২ এর ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাবো। তবে আমাদের শর্ত রয়েছে। রাখাইনে আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। অবাধ চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের ভিটে বাড়ি ও জমি ফেরত দিতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাহলেই আমরা ফিরে যাবো।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যাবতীয় প্রস্তুতির কথা জানিয়ে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের নয়াপাড়া কেরুণতলী নাফ নদীর পাড়ে ও স্থালপথে ঘুমধুম সীমান্তে ট্রানজিট ক্যাম্প প্রস্তুত করা হয়েছে। দুই মাস আগে থেকে এই দুইটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা আশা প্রকাশ করছি আগামী সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবো।’
মোহাম্মদ আবুল কালাম আরও বলেন, ‘গত ৩০ অক্টোবর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা মিয়ানমার সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গার নামের তালিকা রয়েছে। এসব তালিকা যাচাই-বাচাই করে মিয়ানমার প্রথম দফায় ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা জানিয়েছে। অন্যান্যদের পর্যায়ক্রমে প্রত্যাবাসনের আওতায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন চালায়। এ থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পার্সন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট’ নামে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। পরে গত ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।