একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মানদণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তি কাটছে না। অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে কখনও কমিশন থেকে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; আবার কখনও কমিশন নিশ্চুপ থেকেছে। ফলে এক আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা যে কারণে একজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছেন, অন্য আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবার একই ধরনের কারণ থাকার পরও প্রার্থীকে বৈধ ঘোষণা করেছেন। এবারের নির্বাচনেও একই পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা এ বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেও ইসি স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি।
এ ক্ষেত্রে বিশেষত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের বা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের অধীনে চাকরিজীবীসহ বেশকিছু পদের বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।
কমিশনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে পরিপত্র জারির কথা বলা হলেও ইসি সূত্রে জানা গেছে, লিখিত কোনো আদেশ তারা জারি করছেন না। সংশ্নিষ্ট ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরা আপিল করলে তখন কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি কার্যালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ জাগো বাংলা ২৪ ডটকমকে বলেন, বিষয়গুলো আইনে স্পষ্ট করা নেই। তাই কমিশন সচিবালয় থেকে এ নিয়ে পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। এখানে ‘লাভজনক পদে’র সংজ্ঞার বাইরেও স্থানীয় সরকারের পৃথক আইনগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, ইসি এ ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিতে চলেছে। এর আগে নবম সংসদ নির্বাচনে কমিশন থেকে জারি করা পরিপত্রের পর অনেকেই আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। তাই সেই পরিপত্র আর কার্যকর রাখা সম্ভব হয়নি। এ কারণে এবার রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে সবকিছু চূড়ান্ত হবে কমিশনের সভায়।
ইসির পুনর্নির্ধারিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৮ নভেম্বর। বাছাইয়ের সময় ২ ডিসেম্বর। এরই মধ্যে অনেক প্রার্থী ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে কমিশনে এবং সংশ্নিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছেন। কেননা পদে থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তা বৈধ হবে কি-না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। আবার আগেই পদত্যাগ করে কাঙ্ক্ষিত দলীয় মনোনয়ন না পেলে বা অন্য কোনো কারণে প্রার্থী হতে না পারলে বর্তমান পদও হারাতে হবে। তাই ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে বিষয়গুলো প্রার্থীদের কাছে এবং ২ ডিসেম্বরের আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে এবারের নির্বাচন ইসির জন্য বিভিন্ন দিক থেকেই চ্যালেঞ্জের। তাই একই ইস্যুতে দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দুই ধরনের সিদ্ধান্ত ইসিকে নতুন রাজনৈতিক বিতর্কে ফেলতে পারে।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর সারাদেশের রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়ে ইসি আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা চাওয়া হয়। তখন ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিষয়টি তারা পরিপত্র জারি করে জানাবেন।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় সরকারের পদগুলো অবশ্যই লাভজনক। কারণ তারা নিয়মিত অফিস করেন, সরকারি গাড়ি সুবিধাসহ বেতন-ভাতাও পান। তাই তাদের পদ ছেড়ে দিয়েই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া উচিত।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২(১) (আরপিও) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের বা কোন সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না।’ লাভজনক পদ বলতে বোঝাবে ‘প্রজাতন্ত্র বা সরকারি সংবিধবদ্ধ কর্তৃপক্ষ বা ৫০ ভাগের অধিক সরকারের অংশীদারিত্ব সম্পন্ন কোন কোম্পানীতে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত কোন পদ বা অবস্থান।’
আরপিওর একই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের বা কোন সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষার কর্ম বিভাগের চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসরের পরে তিন বছর এবং বরখাস্ত, অপসারণ বা বাধ্যতামূলক অবসরের পর পাঁচ বছর পার না হলে তিনি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষ করার পরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ বা চুক্তি বাতিলের তিন বছর পার না হলে তিনি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না।’
ইসি-সংশ্নিষ্ট বিশ্নেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের আইনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে। এর আগে ড. শামসুল হুদা কমিশনের সময় এ বিষয়ে ইসি থেকে পরিপত্র জারি করা হলেও তা আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ওই সময় ঢাকা সিটির মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, চট্টগ্রাম সিটির মেয়র মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও সিলেট সিটির মেয়র বদরুদ্দীন আহমদ কামরান ইসির সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে হেরে যান। তাই সিটি মেয়রদের বিষয়ে ওই আদেশই পালন করা হচ্ছে।
প্রায় একই সময়ে ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল ও ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌরসভার মেয়ররা আদালতে রিট করলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ইসির পরিপত্র স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এসব মেয়র পরে আর ওই মামলা পরিচালনা করেননি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থেকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই- এমন তথ্য জানানোর পাশাপাশি ইসি কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, আইনে সুযোগ না থাকলেও বর্তমান দশম সংসদে অন্তত তিনজন সাংসদ রয়েছেন, যারা পদে থেকে নির্বাচন করে জয়ী হওয়ার পর পদত্যাগ করেছেন। বর্তমান সংসদের একজন সাংসদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে থেকেই নির্বাচিত হয়েছেন।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, নিয়মিত পেনশনভোগী এমন চাকরিজীবীরা তাদের পদ ছেড়ে দেওয়ার পরের তিন বছর না পেরোলে প্রার্থী হতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদ থেকে তো নয়ই, পদ ছেড়ে দেওয়ার পরও আরও তিন বছর অপেক্ষা করে এমপি পদপ্রার্থী হতে পারবেন। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পদে থেকেই নির্বাচনে বাধা নেই। কারণ আদালতের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ইসির হাতে রয়েছে।