১৯৯৮, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ধর্ষিতা কে? আমিই ধর্ষিতা’ ছাত্রীদের রক্তআগুন করা জমায়েত থেকে সমস্বরে উঠলো এই রব। মুহূর্তেই যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো ধর্ষিতার পরিচিতি। তাকে বিচার বিশ্লেষণ করতে প্রস্তুত কাঠগড়া। বাংলাদেশের নারীবাদী প্রতিবাদের সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে যৌন নিপীড়নের লিঙ্গবাদী বাহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবচ্ছেদের বিষয় নিপীড়িতের পরিচিতিকে গৌণ করে ফেলা হয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে দ্বিতীয়দফা সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করার দাবিতে তার পরিচিতি নয়, ধর্ষকের পরিচিতিকে, ধর্ষণকে মুখ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি ওঠে।
১৯৯৮’র সেই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন কি সফল? মিছিলের, স্লোগানের প্রধান দাবি ছিল ধর্ষকের বিচার, সেটা কি হয়েছে? হয়নি। ‘সেঞ্চুরি মানিক’সহ অন্যান্য ধর্ষকের, অন্যান্য ক্ষমতাশালী নিপীড়কের মতোই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে পুনর্বাসন হয়েছে মাত্র। কিন্তু তা বলে সেই আন্দোলনকে ব্যর্থ তো নয়ই, বরং একে একটি অত্যন্ত সফল আন্দোলন বলা যায়। একে বলা যায়, চৈতন্যের সফলতা, যার অনেক অর্জনের মধ্যে একটি হলো নিপীড়িতের পরিচিতিকে গৌণ করে নিপীড়কের পরিচিতিকে সামনে নিয়ে আসা। ১৯৯৮-এর ছাত্রী জমায়েতের মধ্যে থেকে ‘আমি ধর্ষিতা’ বলে সব ছাত্রীর দাঁড়িয়ে যাওয়া, ধর্ষিতার পরিচিতি প্রকাশ না করে, তার প্রতি আঙুল তোলার, তার চরিত্র কাটাছেঁড়া করার জন্যে তাক করা লিঙ্গবাদী নিশানা ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ধর্ষকের দিকে, ধর্ষণের দিকে।
কিন্তু যে সামাজিক লাঞ্ছনাকে মোকাবিলা করতে নিপীড়িতের পরিচয় গোপন করার কথা আমরা বলি, গোপন করার মধ্য দিয়ে কিন্তু সেই লাঞ্ছনার উৎসটাকে মোকাবিলা করা হয় না। ফলে ১৯৯৮ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে যে চৈতন্য জেগে ওঠে, কুড়ি বছর পর ২০১৮-এর ‘আমিও’ ঝড়ে তার দুই দশকের জেগে ওঠার আরেক দরজা খুলতে দেখি, দেখি নিপীড়িতের পুনঃপুনঃ লাঞ্ছনার ভয় উপেক্ষা করে একে প্রতিরোধ করে দাঁড়াতে। ‘আমিও’ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা এটাই।
দুর্দান্ত সাহসী যে মানুষেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা নিপীড়কের মুখোশ খোলার মাধ্যমে ওই সব ‘নামিদামি’ মানুষের সামাজিক ‘অসম্মান’ করার যত না পথ করছেন, তার একশভাগ বেশি ঝুঁকি তারা নিয়েছেন নিজের অসম্মানের। এই বিশ্ব এমনই এক জাহান্নাম, যেখানে শিশুরা নীরবে শিখে নেয় সেই অসহ্য স্পর্শের কথা কাউকে বলা যাবে না, বুঝে নেয় নীরবতার কৌশল। তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে প্রকাশের বিষাক্ত ভয়। কত কত প্রচেষ্টার পরেও তাদের সে ভয় সরানো যায় না, হাজার বার ভরসা দেওয়ার পরেও কত শিশু মুখ খোলার সাহস পায় না। ছোট্ট বুকের গভীরে জমা করে রাখে ভয়ার্ত স্পর্শের স্মৃতি। মস্তিষ্কের কোণায় পাঠিয়ে দেয়, যে গভীরে ঢুকে ঘুমের মধ্যে তাদের তাড়া করে। একবার কি ভেবে দেখেছি, কেন নীরবতার এই কৌশল শিখে নেয় নিপীড়িতেরা? এর কারণ আমরা প্রত্যেকে। এর কারণ সমাজের মজ্জাগত অসম যৌনতার ধারণা। যেখানে নারীর যৌনতার কথা মানেই বদনাম; যেখানে নারীর শরীর পুরুষালি সমাজের সম্পত্তি, তার নিজের না; যেখানে নারীর যৌনাঙ্গে আক্রমণের অপরাধের দায়ভার বহন করতে হয় তাকেই, অপরাধীকে না; যেখানে যৌন আক্রমণের শিকারকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়; যেখানে ধরেই নেওয়া হয় নারীর শরীর ভোগ্য, নারী নিষ্ক্রিয় ও পুরুষ ভোক্তা; যেখানে সম্মতির যৌনসম্পর্কে আনন্দ উপভোগকারী নারীটি বেশ্যা আর পুরুষ তো পুরুষই; যেখানে নারী তেঁতুল আর পুরুষ লালাঝরা পশু। যেখানে নারীর পোশাকে, তার চলাফেরাকে যৌন হয়রানির কারণ হিসেবে মনে করা হয়। এ রকম আরও কত কত যৌনবাদী ধারণা আমাদের প্রত্যেকের মননে মজ্জাগত হয়ে গেঁথে আছে। যতদিন আমরা এর শেকড় উপড়াতে না পারবো, ততদিন ‘বিচারের দাবি’ একটা সহজ দায়সারা বুলি ছাড়া আর কিছুই না।
ধর্ষণের শিকার নারী ও নিপীড়িতের চরিত্রবিশ্লেষণ শেষে যদিওবা দুই একটা বিচ্ছিন্ন ধর্ষকের বা নিপীড়কের শাস্তি হয়, সেটাও মহামারির কালে দুই একটা ঘা সারিয়ে তোলার মতোই নগণ্য। বিচারের নামে প্রহসনের আড়ালে বৈষম্যমূলক লিঙ্গবাদী ধারণা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। ‘আমিও’ আন্দোলন এই বৈষম্যমূলক যৌনতার ধারণাকেই একটু একটু করে আঘাত করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। নিপীড়িত নারী তার চরিত্রহননের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেই অস্ত্রকে অকার্যকর করে দিয়ে তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যৌন নিপীড়নের দগদগে ঘা সারিয়ে নেওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে।
যৌন নিপীড়নের কারণ এবং এর নিপীড়িতের অসহনীয় ভোগান্তির মূল কারণ যৌনতার বিকৃত ধারণা। যৌন নিপীড়নকে চিনতে পারা, নির্ভয়ে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা বলতে পারা এই বিকৃত ধারণাকে বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে। কারণ নিপীড়িত তার শরীর, সম্মতি-অসম্মতি আর তার স্বর নিয়ে দাঁড়াতে পারে। নিপীড়িতের চরিত্রহননের ভয় ডিঙিয়ে সেই অস্ত্র অকেজো করতে থাকে। আর এভাবেই সম্ভব চরিত্রহননের অস্ত্রকে একটু একটু করে উপড়ে ফেলা।
নারী নির্যাতন আইন যতই কঠিন হোক না কেন, সামাজিক ধারণার পরিবর্তন ছাড়া তার বাস্তবায়ন সম্ভব না। আইন বা বিচার প্রক্রিয়ার পরিবর্তন সামাজিক ধারণার পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব। আর এ কারণেই আমি মনে করি, যৌনতার সামাজিক ধারণার পরিবর্তন ছাড়া যৌন হয়রানির ‘বিচার’ প্রহসন মাত্র। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নে সফল হয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমরা সেই নীতিমালা বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো দেখতে পাই, এবং তা নিয়ে আমরা একটা প্রবন্ধ দৈনিক পত্রিকাতে প্রকাশও করেছিলাম। সেখানে আমরা দেখাই যে, আইন প্রয়োগে প্রতিটি পদক্ষেপে যারা যুক্ত, তাদের নিপীড়কপক্ষীয় মানসিকতা বিচার প্রক্রিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। নীতিমালা গৃহীত হওয়ার পরেও আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বারে বারে খারিজ হতে দেখি, নিপীড়িতের চরিত্রহানি হতে দেখি। নীতিমালাকে একটা প্রহসনে পরিণত হতে দেখি।
পুরো বিশ্বজুড়ে যে ‘মিটু’ ঝড় বাংলাদেশে নিপীড়িতের মুখ খোলার পথ করে দিয়েছে, এর অর্জন আর সফলতা এখানেই। একে ঘিরে প্রচুর আলাপ আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। কেউ বলছেন ‘মি টু’ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সুযোগসন্ধানীর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। হ্যাঁ, হতেই পারে; ঠিক যেভাবে আমরা রাজনৈতিক প্রয়োজনে নানা ধরনেরই মিথ্যা প্রচারণা চলতে দেখি। সেক্ষেত্রে সত্য মিথ্যা বিচারের দায় আমরা আমাদের চৈতন্য দিয়েই করে নিই। ‘মিটু’-এর নিপীড়নের প্রকাশ সেভাবে চৈতন্যের বিচারের পথ পার হয়েই আসবে।
যৌন নিপীড়ক নানা ভাবেই তার রূপ দেখায়। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ না করেও কি আমরা আমাদের ছোট ছোট সামাজিক পরিবৃত্ত থেকেই নিপীড়ককে চিনে নিতে শিখিনি? বরং সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশের পর নিপীড়কও আত্মপক্ষ সমর্থনের বা ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পায়। হলিউডে অনেকেই সেই সুযোগ নিয়েছেন। আর তাছাড়া নিপীড়নের প্রকাশ্য অভিযোগ অনেকক্ষেত্রেই নিপীড়ককে সামাজিকভাবে একঘরে করে না তো বটেই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমন কোনও ক্ষতিই করতে পারে না। যৌননিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্যাসি আফ্লেক নিপীড়নের অভিযোগের পরেও অস্কার জিতে নেন। নিপীড়নের ঘটনা ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক নিপীড়কেরই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বহাল তবিয়তেই চলতে থাকে। এরকম ঘটনা অজস্র আছে আমাদের চারপাশেই। আজকের ‘আমিও’ ঘোষণার অনেক ঘটনাই নিপীড়িতের খুব কাছের বা তাদের বন্ধুমহলের ছোট পরিসরে হয়তো নতুন ছিল না। এ রকম অসংখ্য ঘটনার জানা হতো অসংখ্য পুরুষকে তো কখনও পুরুষালী বন্ধুমহলে একঘরে হতে দেখিনি। প্রিয়তি, সীমন্তী বা শিশিরের বয়ানের প্রকাশ তাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, আবার তার পরেও তাদের চরিত্রহানি করতে পিছপা হয় না নিপীড়কপক্ষীয়রা। কিন্তু যৌন রাজনীতি সচেতন মনন শক্তিশালী হলে আমরা ঠিকই চিনে নিতে পারবো নিপীড়কপক্ষীয় যুক্তির অসারত্ব। আর সেজন্যেই অনেক বেশি খোলামেলা আলোচনা দরকার। দরকার নির্ভয় বিতর্ক।
সবশেষে বলতে চাই, ‘আমিও’ আমাদের সামাজিক বিচারের একটা ক্ষেত্র করে দিয়েছে। এই বিচার অভিযুক্তকে সুস্পষ্টভাবে ‘দোষী’ কিংবা ‘নিরপরাধ’ হিসেবে শনাক্ত করতে পারে না। আমার মতে, এর প্রয়োজনও নেই। কারণ, এর বড় অর্জন নিপীড়কের বিচার নয়, বরং নিপীড়নের উৎস যৌন রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন এবং লিঙ্গবাদী ব্যবস্থায় নারীর চরিত্রহননের অস্ত্রকে অসার করে তোলা। সামাজিকভাবেই এর মোকাবিলা জরুরি, তা না হলে আইন কোনোদিনও নিপীড়িতের সহায় হতে পারবে না। আজকের ‘আমিও’ ধর্ষিতাকে চরিত্রহননের ভয়ে আড়াল করার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে ধর্ষিতার মাথা তুলে দাঁড়াবার পথ করে দেয়। অনেক অনেক ব্যর্থতার পরেও তাই ১৯৯৮ থেকে ২০১৮, এই কুড়িবছরে এভাবেই বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন একধাপ এগিয়ে যায়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।