বিতর্ক যেন পিছ ছাড়ছে না বাংলাদেশের ১৬তম সেনাপ্রধান (সাবেক) জেনারেল আজিজ আহমেদের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার পলাতক সন্ত্রাসী, খুনি ও মাফিয়া ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তার হাত দিয়ে ঘটে গেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকটি কলঙ্কিত ঘটনা। অভিবাসনের মারপ্যাঁচে ফেলে অন্যায়ভাবে দুই শতাধিক সামরিক কর্মকর্তাকে চাকরি ত্যাগে বাধ্য করেন তিনি।
এবিষয়ে কিছু তথ্য-প্রমাণাদি স্টেটওয়াচের হাতে এসেছে। সেসব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো কারণ ছাড়াই সঠিক প্রক্রিয়ায় এবং অনুমোদন সাপেক্ষে অভিবাসনে থাকা ২৩৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেন জেনারেল আজিজ।
২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। বিডিআরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে কেবল ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তাই প্রাণ হারাননি, সে সময় অনেক সেনা কর্মকর্তাকে দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের কিছু শর্ত সাপেক্ষে বৈদেশিক অভিবাসন গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়। অনেক সামরিক কর্মকর্তার আত্মীয়রা বিভিন্ন দেশে থাকার সুবাদে অনেকেই নিজ ও পরিবারের জন্যে সকল রকমের অনুমতি গ্রহণপূর্বক বৈদেশিক অভিবাসন গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক ইস্যুকৃত এক চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯-২০১০ সালে সেনাসদর সেনা কর্মকর্তাদের জাতিসংঘে চাকরি ও অনুমতি সাপেক্ষে বৈদেশিক অভিবাসন অনুমোদন করে। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আরেকটি চিঠিতে বৈদেশিক অভিবাসন স্থগিত করা হয়।
এবং সবশেষ চিঠিতে জেনারেল আজিজ ২০১৮ সালে নির্দেশ দেন যাদের অভিবাসন আছে তাদের সেগুলো বাতিল করতে হবে, অন্যথায় সেনাপ্রধান তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। যার অর্থ তাদের এক প্রকারের চাকরি হতে অব্যাহতি।
অথচ এসব সেনাকর্মকর্তা নিজ থেকে বলেননি যে তাদের বৈদেশিক অভিবাসন প্রয়োজন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই চিঠি ইস্যু করে অভিবাসনের পথ সুগম করে।তাদের আবেদন করতে বলা হয়েলছিল, আবেদন করার পরেই তারা অভিবাসন গ্রহণ করেন। এবং পরে আবার আরেক সেনাপ্রধান সেটা স্থগিত করেন। এসব কর্মকর্তা সকল নিয়ম মেনে ২-৩ বছর ধরে প্রতিটি ক্লিয়ারেনস নিয়েই অভিবাসন প্রক্রিয়া করেছেন এবং ২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে অনেক কর্মকর্তাই বিভিন্ন দেশের গ্রিন কার্ড (নাগরিকত্ব নয়) অর্জন করেন।
আর জেনারেল আজিজ এসে অভিবাসন সারেন্ডার করতে বলেন, এর ব্যত্যয় ঘটলে তিনি নির্দেশনা দিলেন চাকরিই থাকবে না!
২০১৭ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল বেলাল একটি চিঠি ইস্যু করেন। এই মর্মে আদেশ জারি করেন যে, এখন থেকে আর কোন কর্মকর্তা অভিবাসন গ্রহণ করতে পারবেন না, কিন্তু যারা গ্রহণ করেছেন তারা কোনো সমস্যা ছাড়াই তা রাখতে পারবেন। অর্থাৎ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে বন্ধ ঘোষণায় নির্দেশ দেন, তবে যারা ইতিমধ্যে অভিবাসী হয়েছেন তারা বহাল থাকতে পারবেন।
কিন্তু ২০১৮ সালের আগস্টে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আবার আরেকটি চিঠি ইস্যু করে আদেশ প্রদান করেন। আদেশে বলেন, যে সকল সেনাকর্মকর্তা বৈদেশিক অভিবাসন গ্রহণ করেছেন তা বাতিল করতে হবে, অন্যথায় সামরিক বাহিনীর চাকরি ত্যাগ করতে হবে।
একইভাবে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আজিজ আরেকটি চিঠি ইস্যু করেন, যা অনুযায়ী শুধু কর্মকর্তাই না, তার স্ত্রী ও ২৫ বছরের কম বয়সী সন্তানদেরও বৈদেশিক অভিবাসন থাকলে তা বাতিল করতে হবে, অন্যথায় চাকরি ত্যাগ করতে হবে।
অভিবাসন গ্রহণকারী অনেকের সন্তানই বিদেশে লেখাপড়া করছিলেন, কারও চাকরিও ছিল প্রায় শেষের পথে, কারও পারিবারিক বিষয় জড়িত ছিল। বৈদেশিক অভিবাসনের এরকম মারপ্যাঁচে পড়ে কমপক্ষে ২৩৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে (২০২১ সাল পর্যন্ত) চাকরি খোয়াতে হয়। যার মধ্যে রয়েছেন ক্যাপ্টেন পদবী থেকে শুরু করে মেজর জেনারেল পদবী পর্যন্ত কর্মকর্তা।
তবে এমন না যে যারা সারেন্ডার করেননি তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়, এখনো অনেকেই আছেন যাদের বৈদেশিক অভিবাসন আছে। বৈদেশিক অভিবাসন-নাগরিকত্ব নিয়ে যদি কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে পারেন, তাহলে ওই ২৩৩ জন কর্মকর্তার কী অপরাধ ছিল? তারা কী অন্যায় করেছিলেন যে কেবল তারাই শিকার হলেন? আর সামরিক বাহিনীর অভিবাসন নীতিমালা সম্পূর্ণ সশস্ত্র বাহিনীর (নৌ-বিমান-সেনা) জন্যই এক হওয়ার কথা, তবে কেন শুধু সেনা কর্মকর্তাদেরই এর টার্গেট করা হলো?
আর কেউই যেন বৈদেশিক অভিবাসন গ্রহণ না করেন, এ বিষয়ে নতুন নিয়ম করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, কিন্তু যারা সকল নিয়ম মেনে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন তাদের কেন চাকরিচ্যুত করা হলো? তারা তো কোনো অপরাধ করেননি!
এই ২৩৩ জনের মধ্যে অধিকাংশ কর্মকর্তারই সামরিক ট্রেস মার্ক ৮০ এর ওপরে। এমনও কর্মকর্তা ছিলেন যাদের ট্রেস মার্ক ৯০। কর্মকর্তা কতটা চৌকস ও পদোন্নতী পাবার যোগ্য, সেটা নির্ধারণ করা হয় তাদের এই ট্রেস মার্কের উপর। এদের মধ্যে এমন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা নিজ কোর্স তো বটেই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেরা অফিসার বলেও পরিচিত ছিলেন। ৯০’র দশকে বিদেশি নাগরিক বিয়ে করার অনুমতি পেয়েছিলেন এমন কর্মকর্তাও এই মারপ্যাঁচ থেকে রেহাই পাননি!
শুধু অভিবাসন নীতিমালা পরিবর্তন করে ২৩৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে চাকরি ত্যাগে বাধ্য করেই সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ক্ষ্যান্ত হননি। অতি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কারণে আরও ৭৩ জন সেনা কর্মকর্তাকেও তথাকথিত ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ নামে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। অথচ নিজে তার পলাতক সন্ত্রাসী ভাইদের সাথে বছরের পর বছর গোপনে যোগাযোগ রেখে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে এবং অধীনস্ত কর্মকর্তাদের অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে সামরিক আইনের বিভিন্ন ধারাতেই ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’সহ মারাত্মক শাস্তি যোগ্য অপরাধ করেছেন তিনি।
বৈদেশিক অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করে চৌকস ২৩৩ জন সামরিক কর্মকর্তার অব্যাহতি ও নিজে ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’ করে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অজুহাতে আরও ৭৩ জনকে চাকরিচ্যুত করে মোট ৩০৬ জন সেনা কর্মকর্তাকে বাহিনী থেকে বহিষ্কার করে জেনারেল আজিজ তাদের একরকমের হত্যাই করেছেন। অথচ বিডিআরের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে সেদিন খুন হয়েছিলেন ৫৭ জন কর্মকর্তা! সেদিক থেকে বলাই যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়টি রচিত হয়েছে সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদের হাতে!