দেশে বর্তমানে প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহে যে সংকট রয়েছে তাতে ভারসাম্য আসতে পারে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। এ ছাড়া সারাদেশে একই দামে প্রযুক্তি পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেবেন বলেও জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন আগামী দিনের পরিকল্পনা, ব্যবসায়িক উদ্যোগ, করোনাকালে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলার বিষয়গুলো নিয়ে।
⬛ দেশের প্রযুক্তি পণ্যের বাজার এখন কেমন?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত অবশ্যই দিন দিন বড় হচ্ছে। লকডাউনের সময় কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের কাছে প্রযুক্তিই ছিল বড় মাধ্যম। এখন ঘর থেকে বের না হয়েও যে অনেক কাজ চালিয়ে নেওয়া যায় সেটা লোকজন বুঝে গেছে। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হলে এই বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে।
⬛ করোনাকাল কীভাবে মোকাবিলা করলেন?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: প্রথমে খুব কনফিউজড ছিলাম। ধৈর্য ধরেছি। অফিসের সবাই জুম কলের মাধ্যমে একে অপরের খোঁজখবর রেখেছি। পাশাপাশি যতটুকু সামর্থ্য ছিল সেটুকু দিয়ে কর্মীদের চিকিৎসা ও আরও যত সহযোগিতা করা সম্ভব করেছি। বেতন-বোনাসও চালিয়ে গিয়েছি যতটুকু সম্ভব হয়েছে।
এরপর কিন্তু প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। যেহেতু সবাইকে বাসা থেকে অফিস করতে হবে, ক্লাস করতে হবে, এ জন্য দরকার প্রযুক্তি। এতে প্রোডাক্টের যে স্টক ছিল সেটা বিক্রি হয়ে যায়। এখন আমরা যে সমস্যায় পড়েছি সেটা হলো সাপ্লাই ইস্যু। সারা বিশ্বেই এখন প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় কম। অনেক ক্ষেত্রে সাপ্লাই বিঘ্নিত হয়েছে। এজন্য অনেক পণ্য সময়মতো পাইনি। তবে আমাদের সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। ঠিকমতো যোগান দিতে পারছি। কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন পরিবহন খরচ বেড়েছে। এতে পণ্যের দামও বেড়েছে।
⬛ প্রযুক্তি পণ্যের দাম আবার কমবে কবে?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: আমরা সরবরাহকারীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই মুহূর্তে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বরং অল্পবিস্তর বাড়তে পারে। এখন অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগোচ্ছে বলে প্রসেসরের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সাপ্লাইয়ে দেরি হচ্ছে। যেহেতু গোটা বিশ্বে চিপ তৈরির প্রতিষ্ঠান কম, তাই সরবরাহ বাড়তে সময় লাগবে। আশা করছি ২০২৩ সালের মাঝামাঝি প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহে ভারসাম্য আসবে।
⬛ আপনি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) নির্বাহী কমিটির নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ নির্বাচনে কেন?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: আমার কাছে মনে হচ্ছে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে যাদের ব্যবসা করার মন-মানসিকতা রয়েছে তাদের সবারই কিছু অবদান রাখা উচিত। বিসিএস আমাদের প্রাণের সংগঠন। এর জোরালো পদক্ষেপের কারণেই কিন্তু কম্পিউটার মার্কেট এই পর্যায়ে এসেছে। ১৯৯৬ সালে কম্পিউটার সমিতির প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সরকার কম্পিউটারকে ভ্যাট-ট্যাক্স মুক্ত রাখে। কম্পিউটার বাজারের প্রসারে এই সমিতির কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই সংগঠনে আগে দুবার কাজ করেছি (একবার মহাসচিব, একবার পরিচালক)। আমার কাছে মনে হয় এখন কম্পিউটার সমিতির যে কার্যক্রম সেখানে আরও কিছু করার আছে। এখানে পদ বড় বিষয় নয়। আর এটা কোনও পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন নয়। এটা পেশাদার কর্মীদের সংগঠন। এখানে পদের ভিত্তিতে ভোট করছি না। সমিতিতে গিয়ে যেখানে পরিবর্তন করা দরকার সেই কাজগুলো শুরু করতে চাই। বাজার সম্প্রসারণের ইচ্ছা থেকে ভালো একটা টিম তৈরি করতে চাই।
⬛ নির্বাচনে আপনার প্রতিশ্রুতি কী হবে?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: আমি মনে করি, বিসিএসের প্রত্যেক সদস্যের মনেই এই প্রশ্ন থাকা উচিত— কেন তারা নেতৃত্বে আসতে চাচ্ছেন, কী দিতে চাচ্ছেন? অনেক পরিকল্পনা আছে। এই মুহূর্তে সব বলতে চাচ্ছি না। বিসিএস যেভাবে চলছে আমরা সেটার অনেকটাই পরিবর্তন চাই। নেতা নয়, বরং সংগঠন যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে বিসিএস অনেকটাই নেতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আমরা সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী করতে চাই।
⬛ বিসিএস দেশের প্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন। কিন্তু প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য সংগঠন বিসিএস থেকে এগিয়ে গেছে। বিসিএসকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে কী ধরনের পরিকল্পনা থাকবে?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: বিসিএস’র কর্মপরিধি বাড়ানোর জন্য আমাদের বড় ধরনের পরিকল্পনা আছে। আমি বলবো বিসিএস একটি মাদার অর্গানাইজেশন।
⬛ হার্ডওয়্যার পণ্যে এখনও আমরা আমদানিনির্ভর। এ খাতে এখনও বড় আকারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখতে পারিনি।
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: এ খাতে রফতানিমুখী হওয়ার চিন্তা অনেক সুদূরপ্রসারী। প্রযুক্তির উৎপাদন কাঠামো কনভেনশনাল গার্মেন্টসের মতো নয়। এটা শ্রমনির্ভরও নয়। সম্পূর্ণই টেকনোলজি অরিয়েন্টেড ফ্যাক্টরি। আমাদের এখানে কাঁচামাল যতদিন না তৈরি করতে পারবো ততদিন রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবো না। আমাদের এখানে আইটি পণ্যের যে স্কিলড লেবার দরকার সে জায়গাগুলো সিলেক্ট করে অ্যাসেম্বল করা যেতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে উৎপাদনে যেতে পারি।
কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। চট্টগ্রাম ইপিজেডে আমাদের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে ইউএসবি ক্যাবল তৈরি হচ্ছে। সেই ক্যাবল যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিও হচ্ছে।
⬛ দেশে আইটি প্রোডাক্ট বলতে আমরা শুধু কম্পিউটার, ল্যাপটপ বুঝি। আইটি পণ্যের তালিকায় আরও তো অনেক কিছু আছে।
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: আইটির পরিধি বিশাল। একটা রেফ্রিজারেটরেও এখন ই-মেইল চেক করা যায়। সেটার মধ্যেও স্ক্রিন দেওয়া থাকে। বিশ্ববাজারের ব্যবসার যে ট্রেন্ড, তাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আবার আইটি সাপোর্টের বাজারও বড়। ভারতের প্রথম সারির কিছু কোম্পানি আছে, তাদের মূল ব্যবসাই হলো আইটি সাপোর্ট। আইটি সাপোর্ট আমরা আউটসোর্সিং আকারে দেশের বাইরে দিতে পারি। এটা দিয়েও অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।
মার্কেটে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার। এখন অনেক শপিং মলে আইটি প্রোডাক্ট বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা ভিজিট করে পণ্য দেখেশুনে এবং কার্যকারিতা দেখে কেনার সুযোগ পাচ্ছে। অনলাইন-অফলাইন দুটো জায়গাকেই আমরা এক করে কাজ করার চেষ্টা করবো।
⬛ ‘এক দেশ এক রেটে’ পণ্য বিক্রির কোনও পরিকল্পনা আছে কী?
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: অবশ্যই এই ইচ্ছা আছে। এটাই হওয়া উচিত। ক্রেতারা ঢাকায় যে দামে পণ্য কিনে থাকেন, গ্রাম থেকেও যেন একই দামে সেটা কিনতে পারেন—তা আমাদের পরিকল্পনায় থাকবে। অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার কারণে অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা চাইবো ব্যবসায়ীরাও যেন ব্যবসা করতে পারেন।
আবার পণ্য বিক্রিই শেষ কথা নয়। বিক্রয়োত্তর সেবা বলেও একটি বিষয় রয়েছে। আইটি পণ্যে ওই সেবাটাই বেশি জরুরি। তবে লাভ করতে না পারলে সেই সেবাটাও দেওয়া যায় না।
আমরা ভোক্তা অধিকারের কথা যদি চিন্তা করি, তবে দু’দিকই বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করবো ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিতে। তারা যেন সারাদেশে একই মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন। অফলাইন ও অনলাইনেও যেন পণ্যের দামে সামঞ্জস্য থাকে। সব মিলিয়ে, আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ে যেন একটা সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে।