আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আট বছর পূর্ণ হবে। এই সময়ের মধ্যে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে, মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে অনুপ্রবেশ করেছিল প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধভাবে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখের কাছাকাছি। অর্ধযুগ ধরে তাদের স্বেচ্ছাসেবী প্রত্যাবাসনের জন্য নানা প্রচেষ্টা চালানো হলেও আজও সফলতা আসেনি। এতে করে হতাশার শেষ নেই, কারণ বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগণ্য নেই।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সম্মেলন শুরু হয়েছে রোববার (২৪ আগস্ট) এবং চলবে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত, উখিয়ার ইনানীর সেনানিবাস পরিচালিত হোটেল বে-ওয়াচ মিলনায়তনে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন দেশ, সংস্থা এবং ব্যক্তিগত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এই সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা।
অতীতে রমজান মাসে (১৪ মার্চ) জাতিসংঘের মহাসচিবের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের এক সমাবেশে ড. ইউনূস বলেছিলেন, এই ঈদ না হলেও, ভবিষ্যত ঈদে রোহিঙ্গারা নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি দেখছে বিশেষজ্ঞরা, তারা মনে করছেন, রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। পাশাপাশি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে অপ্রাপ্তি এবং নানা বাধা মোকাবিলা করে এই সংকটের সমাধান সম্ভব কি না, তা নিয়ে আদৌ সন্দেহের আশঙ্কাও রয়েছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কারণে বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দিন দিন ভোগান্তি বাড়ছে, অপরাধ, মাদক, সহিংসতা তথা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে উখিয়া ও টেকনাফের নিত্যদিনের জীবন একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংলাপকে এক নতুন সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে অন্যতম অংশগ্রহণকারী হিসেবে থাকবেন দেশের ও দেশের বাইরে বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাবিদ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা, যার সংখ্যা কমপক্ষে ৪০টি দেশের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটকে আন্তর্জাতিক মহলে হস্তান্তর করা খুবই কঠিন work। এই সম্মেলনে রোহিঙ্গারা সরাসরি তাদের অনুভূতি ও মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। মূল আলোচনা হবে মানবিক সহায়তা, নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে। ২৪ ও ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে বিভিন্ন কর্মসূচি, যেখানে মূল আলোচনায় থাকবে এই তিন বিষয়ে। ২৬ আগস্ট অতিথিরা উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শন করবেন।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশে আসার পর থেকেই রোহিঙ্গাদের সমস্যা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠিত ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও পরিকল্পনা বৃহত্তর অঙ্গীকারের পথ খুলে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, অার আন্তর্জাতিক সম্মেলনের একটি প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে কক্সবাজারের এই আয়োজনকে, যার মাধ্যমে ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হবে।
গত কয়েক বছর ধরে রাখাইনে চলমান অস্থিতিশীলতা ও সংঘর্ষের কারণে ২০১৭ সালে ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখন তাদের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে, অপরাধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে স্থানীয় মানুষের জীবন। একদিকে অপরাধ, অন্যদিকে ইয়াবা, মাদক ও সহিংসতার বিস্তার, ফলে উখিয়া-টেকনাফের জীবনযাত্রা খুবই বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন ধরে অপ্রকাশ্যভাবে চলা এক প্রত্যাশা এবং আশিয়ানা যে, আন্তর্জাতিক এই সংলাপ এখন নতুন আশার আলো এনে দিতে পারে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিনিধিরা। এছাড়াও, সরকারের পক্ষ থেকেও এ আলোচনা গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে, প্রত্যাবাসন, নিরাপদে ফেরার পথ ও মানবিক সমাধানের জন্য অঙ্গীকার নেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনজীবী আবদুল মান্নান বলেন, রোহিঙ্গা আশ্রয়ের কারণে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, যদি এই সম্মেলন থেকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য স্পষ্ট রোডম্যাপ বের হয়, সেটাই হবে সত্যিকার অর্থে শান্তির মূল চাবিকাঠি।
সর্বমোট, কক্সবাজারের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও আলোচনার ফলাফল যদি সফল হয়, তাহলে আশার আলো জ্বলে উঠবে রোহিঙ্গাদের জন্য। আট বছর ধরে স্থবির থাকা প্রত্যাবাসনের পথ এবার গতি পাবে বলে সকলের প্রত্যাশা। এই সুচিন্তিত উদ্যোগের মাধ্যমে সম্ভব কি না, সেটিই এখন দেখার ব্যাপার।