গেল বুধবার (২৭ আগস্ট) শুরু হয়েছে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ ৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এই উৎসবের প্রাঙ্গণে দেশি-বিদেশি অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি খোলা চিঠিতে গাজার চলমান পরিস্থিতিকে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন হিসেবে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়ে সক্রিয় উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন।
‘ভেনিস ফর প্যালেস্টাইন’ নামে এই উদ্যোগের পক্ষ থেকে আগেই বিনালে দি ভেনেজিয়াকে এবং উৎসবের দুটি শাখা—ভেনিস ডেজ ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক—কে একটি আবেদনপত্র পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, বিজয়নের পুরো আয়োজন যেন কেবল প্রত্যাশিত ভুতুড়ে প্রদর্শনীতে রূপ না নেয়। বরং, অতীতের মতো স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিয়ে আলোচনা, সংলাপ এবং কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি ভাষাকে সামনে আনতে হবে, যাতে দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘন, জাতিগত নিধন, বর্ণবৈষম্য, অবৈধ দখল, ঔপনিবেশিকতা ও মানবাধিকর্ষের অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সচেতনতা বাড়ে।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির বিখ্যাত অভিনেতা টনি সারভিল্লো, অভিনেত্রী-পরিচালক আলবা ও অ্যালিস রোরওয়াচার, ফরাসি নির্মাতা সেলিন সিয়ামা ও অড্রে দিবান (যিনি ২০২১ সালে ‘হ্যাপেনিং’ ছবির জন্য গোল্ডেন লায়ন জিতেছেন), ব্রিটিশ পরিচালক কেন লোচ (১৯৯৪ সালে অনারারি গোল্ডেন লায়ন পেয়েছেন), ব্রিটিশ অভিনেতা চার্লস ড্যান্স, পাশাপাশি ফিলিস্তিনি নির্মাতা আরাব নাসের ও তারজান নাসের—যারা এই বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবেও ‘ওয়ান্স অপেন অ্যা টাইম ইন গাজা’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন।
চিঠিতে তারা আরও উল্লেখ করেন, যখন বিশ্বব্যাপী ভেনিস ছবি উৎসবের আলোচনা শুরু হয়েছে, তখনও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই বিশাল আয়োজন মানবিক ও রাজনৈতিক এই সংকটের প্রতি উদাসীন থাকলেও পারে। তাঁরা বলেন, ‘শো’ চলবে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে দূরে থাকতে পারে। বলা হচ্ছে, ‘শো মাস্ট গো অন’—অর্থাৎ, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দর্শককে বলার চেষ্টা চলছে যেন বাস্তবের জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
তারা আরও যোগ করেন, এই উদাসীনতা ভাঙতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানবতা ছাড়া কোনো চলচ্চিত্রের জায়গা নেই। শেষ দিকের আহ্বানে তারা জানান, ‘এই উৎসবকে অর্থবহ করে তুলুন, যাতে এটি শূন্য বা আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে উঠে। আসুন সবাই মিলে সাহস ও সততার সঙ্গে বলি— ফ্রি প্যালেস্টাইন!’
অন্যদিকে, এই খোলা চিঠির প্রতিক্রিয়ায় বিনালে দ্রুত বিবৃতি দেয়। তারা জানায়, তারা ও ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব সবসময়ই মুক্ত আলোচনা ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর জন্য সংবেদনশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এসেছে। তারা এই বছর প্রতিযোগিতা বিভাগে থাকা তিউনিসিয়ার পরিচালক কাওথের বেন হানিয়ার ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ চলচ্চিত্রের উদাহরণ দেয়। এই ছবি ২০২৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এক পাঁচ বছরের ফিলিস্তিনি শিশুর গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গত বছরের প্রতিযোগিতা তালিকায় ছিল ইসরায়েলি নির্মাতা দানি রোজেনবারগের ‘অব ডগস অ্যান্ড মেন’, যা ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত। তাঁরা জানায়, বিনালে সবসময় সংলাপের জন্য উন্মুক্ত।
‘ভেনিস ফর প্যালেস্টাইন’ এবং বিনালের এই বিবৃতি এমন এক সময়ে এসেছে যখন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ও মন্তব্যে গাজার মানবিক সংকটের গভীরতা স্পষ্ট হয়। সম্প্রতি মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন জানিয়েছে, গাজার মানুষ এখন ‘মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে’ ভুগছে, যদিও ইসরায়েল এই তথ্য অস্বীকার করছে।
এছাড়া, এই আলোচনাগুলোর সময় এসেছে যখন আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সম্মেলন হতে যাচ্ছে, যেখানে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কানাডাসহ একাধিক দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সর্বশেষ, আজকের দিন থেকে শুরু হয়ে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে এই ৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।