জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে চূড়ান্ত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর ভাষ্য পাঠানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিটি দলকে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে দুজন করে প্রতিনিধি নাম পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এই সংক্রান্ত মেইল বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় পাঠানো হয়েছে।
এর আগে, রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ জানিয়েছেন, রাতের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘জুলাই সনদে’র ভাষ্য পাঠানো হবে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠকদের জন্য এভাবেই হুবহু তুলে ধরা হলো:
> জুলাই জাতীয় সনদ ২০২5
>
> দীর্ঘ সময়ের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সফল ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই নিরিখে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীরা, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও দলীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে দেশের সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একে অপরের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
১. পটভূমি
প্রায় দুই শতকের ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলা এর অংশ হয়, কিন্তু পাকিস্তানি সরকারী স্বৈরশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ নানা আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা, স্বায়ত্তশাসন ও গণআন্দোলনের মাধ্যমে ৭০’র দশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর থেকে রাষ্ট্রের গঠনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক প্রকৃতির বিকাশে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে একদলীয় শাসন, সেনাশাসন, জোটের ক্ষমতা ও কমিশনের দুর্বলতা। ২০০৬-২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একের পর এক স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে।
বিশেষ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার, সংবিধান বিকৃতি, ভোটের জালিয়াতি, বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দলীয়ীকরণ, এবং দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের মতো গুরুতর দুষ্টাচার্য চলছে। এহেন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা এই অস্থির পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিজয় স্বরূপ, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিশাল গণঅভ্যুত্থানে শত শত স্কুল-ছাত্র, শ্রমিক, নারী ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। এই গণঅভ্যুত্থানে বিদেশী রেমিট্যান্সের প্রেরকরা তাদের অবদান রাখেন।
অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেনাবাহিনী ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দল যাচাই করে স্বৈরশাসনের পতন নিশ্চিত করে। এতে প্রায় এক হাজার নিরস্ত্র নাগরিক নিহত ও ২০ হাজারেরও বেশি আহত হন। জনগণের ত্যাগ ও রয়েছে জনগণের সুদৃঢ় প্রতিরোধের অসাধারণ ইতিহাস। এর ফলে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পালিয়ে যায়।
এখন জনগণের মনে রাষ্ট্রের কাঠামো ও সংবিধান সংস্কারের গভীর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। সরকারের নেওয়া এই চমকপ্রদ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক গঠন ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সামনের দিনগুলোতে নীতি পরিবর্তন ও সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অস্তিত্ব সংকটে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংবিধান ও নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার এই প্রক্রিয়ার মূল প্রস্তাব।
২. সংস্কার কমিশন গঠন
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন শীর্ষ সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরপর ৩ অক্টোবর তারিখে পঞ্চম একক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাঁচটি মূল সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, নির্বাচন, বিচার, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ক কমিশন। এই কমিশনগুলো বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিসহ আলোচনা করে, তাদের সুপারিশসমূহ ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে সরকারের কাছে জমা দেয়।
৩. জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গঠন
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে থাকেন প্রধান উপদেষ্টা, এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কমিশনের প্রতিনিধি। এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবিধান, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিচার, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে ত্বরান্বিত আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা।
অতঃপর, এই কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ প্রস্তুত করা হয়, যেখানে বিভিন্ন দলের মতামত ও ভিন্নমত একত্রিত হয়ে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সরকার ব্যবস্থার সুস্থতার জন্য জরুরি প্রস্তাবগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রস্তাবনা সকলের ঐক্য ও সহযোগিতায় দেশের উন্নয়নের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে।