বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে প্রতীকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিজেদের উদ্দেশ্য ও পরিচিতি বজায় রাখতে এই প্রতীকগুলোর ওপর নির্ভর করে আসছে। ইসি (নির্বাচন কমিশন) এর নিয়ম অনুযায়ী, ভোটের সময় প্রার্থীর নামের পাশে প্রদর্শিত হয় প্রতীকের মাধ্যমে। এই প্রতীকগুলো সাধারণ মানুষের কাছে স্বপক্ষে বিশ্বাস ও পরিচিতিযুক্ত হয়ে উঠেছে, যা ভোটকেন্দ্রের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচনী প্রতীকগুলোর মধ্যে ধানের শীষ, নৌকা, লাঙ্গল এবং দাঁড়িপাল্লা উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের Perspective থেকে দেখা যায়, এই প্রতীকগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ধানের শীষ, যা মূলত বিএনপির শিরোনাম প্রতীক হিসেবে পরিচিত, এর প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি প্রথম এই প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই প্রতীক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রতীক ছিল। ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠনের পরে এই প্রতীকটি এরশাদ সরকারের আমলে থেকে শুরু করে পরবর্তী নির্বাচনে অটুট থাকে। বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের কিছু অংশও ধানের শীষকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতো, যা পরবর্তীতে বিএনপির প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
অপর দিকে, আওয়ামী লীগের মূল প্রতীক নৌকা, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রথম নির্বাচনের সময় থেকেই প্রতিষ্ঠিত। ১৯৫৭ সালে পেড়ে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, যখন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে। নদীপ্রেমী বাংলাদেশে নৌকা ছিল সাধারণ মানুষের কাছে খুবই পরিচিত ও আস্থা অর্জনকারী প্রতীক। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে ব্যাপক বিজয় লাভ করে, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তবে, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের কারণে ২০২৪ সালের নির্বাচনে এই প্রতীকটি স্থগিত রয়েছে।
লাঙ্গল, অন্যদিকে, বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রতীক হলেও এর ইতিহাস বহু পুরোনো। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে এই প্রতীক ব্যবহার করা হয়, যেখানে আতাউর রহমানের দল এই প্রতীক দিয়ে অংশ নেয়। পরবর্তী সময়ে, ১৯৮৪ সালে এরশাদের শাসনামলে এই প্রতীকটি জাতীয় পার্টির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা ইতিহাসে রয়ে গেছে। বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, এতদিন ধরে এই প্রতীকটির নিয়ন্ত্রণ নানা সময় বদল হলেও এরশাদের দল এটি ধরে রেখেছে।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হলো দাঁড়িপাল্লা, যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জামায়াতের প্রতীকের তালিকায় ছিল। জামায়াত সংবাদমাধ্যমে প্রথম ১৯৮৬ সালে এই প্রতীকের জন্য আবেদন করে, পরে ২০০৮ সালেও তারা এই প্রতীক পায়। তবে, ২০১৩ সালে হাইকোর্টের এক রিটের মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়। সম্প্রতি, ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এই প্রতীক থেকে বাতিল হয়, তবে ২০১৭ সালে আবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ইসি। এখন জামায়াত পুনরায় এই প্রতীকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নির্বাচনী প্রতীকগুলো নিয়ে ইসির কর্মকাণ্ড ও নিয়ম প্রক্রিয়া অবশ্যই বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়েছে। কখনো দলগুলো এক প্রতীকের জন্য দাবি জানিয়ে থাকলেও, কখনো প্রতীকগুলো দেখা দিয়েছে সামঞ্জস্য বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে বিভ্রান্তির সৃষ্টিতে। উদাহরণ স্বরূপ, গামছা বা জাহাজ মার্কার জন্য সংঘর্ষ, কিংবা বহুল পরিচিত প্রতীকগুলোর অনুরূপতা যা সাধারণ ভোটারদের বিভ্রান্ত করে।
সাধারণত, নির্বাচনি ব্যালটে প্রতীকগুলো সাদা-কালো রঙের হয়। এই প্রতীকগুলো ফুল, শাপলা, গোলাপ বা অন্যান্য নানা রঙিন ফুলের মতো দেখতে একসঙ্গে আসে, যা ভিন্ন ভোটারের জন্য বোঝাপড়া কঠিন করে তোলে। এদিকে, প্রতীক নিয়ে বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্ব থাকলেও, এসব প্রতীক বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। 예