ধর্মেন্দ্র এবং দিলীপ কুমারের সম্পর্ক ছিল সাধারণ সহকর্মীর থেকেও গভীর ও আন্তরিক। এটি ছিল এক পারিবারিক বন্ধনের মতো, যেখানে ধরণজি দিলীপ কুমারের প্রতি ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভক্তির অনুভূতি, আর দিলীপ সাহেবও তাকে আপন ছোট ভাইয়ের মতোই আগলে রাখতেন। ধর্মেন্দ্রপ্রয়াণের পর, সেই সম্পর্কের স্মৃতিগুলো যেন শোকের সাথে জড়িয়ে যায়, সায়রা বানু তার হৃদয়ের গভীর থেকে শেয়ার করেছেন এক হৃদয়স্পর্শী স্মৃতি, যা যেন এক যুগের প্রস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো।
সায়রা লিখেছেন—
“ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু আমাদের জীবনের এক অধ্যায় ধীরে ধীরে শেষ করে দিল। এটি শুধুমাত্র একজন সিনেমার সহশিল্পীর হারানোর ঘটনা নয়, আমার জন্য এই ক্ষতি অনেক বেশি, কারণ তিনি ছিলেন আমার ইউসুফ সাহেবের ‘ধরণজি’।
আমি বারবার ফিরে যাই সেই স্মৃতিতে, যেখানে ধর্মেন্দ্র স্বয়ং বলেছেন—একজন সরল, বিনয়ী মানুষের গলায়। ১৯৫২ সালে, লুধিয়ানার এক তরুণ ছিলেন তিনি, ‘শহীদ’ ছবির মুক্তির পর, বম্বের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, শুধুই তার প্রিয় অভিনেতার দেখা পাওয়ার জন্য। তিনি সেই সময় ব্যান্ড্রার পালি হিলে গিয়ে দেখেছিলেন দিলীপ সাহেবকে, যেখানে তিনি থাকতেন। কেউ তাকে বাধা দেননি, আর সেই সুযোগে তিনি ভেতরে ঢুকেছিলেন। দেখলেন, ইউসুফ সাহেব সোফায় ঘুমোচ্ছেন, বিকেলের নরম আলো তার মুখে। ভয়ে ভয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ দিলীপ সাহেব জেগে উঠলেন, এবং সেই সময় সোজা হিসেবে ধর্মেন্দ্র দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। এরকম ছোট ছোট ঘটনাগুলো তৎকালীন সময়ে ধর্মজির মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
ছয় বছর পর, ভাগ্য আবার তাদের মিলিয়ে দিল। ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে। ইউসুফ সাহেবের ছোট বোন ফারিদা এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন তরুণ ধর্মেন্দ্র দাঁড়িয়ে ছিলেন, একজন বড় ভাইয়ের সামনে। দিলীপ কুমারের উষ্ণতা ও মমতা তা মুহূর্তে তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেই সন্ধানে, ঠান্ডা রাতে, দিলীপ সাহেব তার সোয়েটার খুলে দিয়ে ধর্মজির কাঁধে জড়িয়ে দেন—একটি নিঃস্বার্থ এবং গভীর প্রেমের প্রতীক। সেই মুহূর্তে তাদের সম্পর্কের প্রথম সূচনা হয়।
এরপর থেকে ধর্মেন্দ্র ছিলেন পরিবারের অংশ। মাঝরাতে বা ভোরে তিনি যখন আসতেন, তখন সবাই তাকে একই ভালোবাসায় গ্রহণ করতেন। কখনো তিনি খ্যাতির চাপের বোঝা মনে করেন, তখন তিনি ইউসুফ সাহেবের কাছে আশ্রয় নিতেন, জীবনযাত্রার মূল্যবোধগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানসিক অনুপ্রেরণা দিতেন।
আজও আমি মনের চোখে দেখি সেই গভীর রাতে, যখন ধর্মেন্দ্র এসে হাজির হন হাতে ‘বেতাব’ ছবির সানির ছবি নিয়ে। তিনি একটু উদ্বিগ্ন, যেন নতুন দায়িত্বের চাপ; তার গলায় ছিল দ্বিধা ও আনন্দের মিশেল। ইউসুফ সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন, তার স্নেহের মতো ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। এরপর ধর্মেন্দ্র শান্ত হয়, হাসিমুখে ফিরে যান নিজের অঙ্গনে। সেই রাতটি যেন আরেকটি গভীর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার সফল স্পর্শ ছিল।
তাদের একমাত্র একসঙ্গে করা ছবিতে ‘পারি’, কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্ব ও সম্পর্কটা লাইট-ক্যামেরা ছাপিয়ে গড়ে উঠেছিল। ধর্মেন্দ্রের বাড়িতে, তাঁর পরিবারের পাশাপাশি মূল স্থানে রাখা ছিল ইউসুফ সাহেবের ছবি, যা সেই সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করে।
ধর্মেন্দ্র প্রায়ই বলে থাকতেন, “সায়রা, আমি তো ইউসুফ সাহেবের ভালোবাসায় তোমার সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করি!” তার দুষ্টুমি ও হাসি দেখে বোঝা যায়, এই সম্পর্কের গভীরতা কত।
আজ, এই মহান হৃদয়সম্পন্ন মানুষটিকে বিদায় জানাতে গিয়ে মনোবাঞ্ছা হয়, তার বিনয়, নিবিড় আনুগত্য ও বিশাল হৃদয় যেন চিরকাল মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। এই মহান ব্যক্তির আত্মা যেন শান্তি পায়, জীবন যেন আলোকময় এবং ঈশ্বরের দয়ার ছায়ায় থাকুক। আমি প্রার্থনা করি, তিনি চিরশান্তিতে বিশ্রাম পান।

