যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে চুরি হওয়া বাংলাদেশের ডলার উদ্ধারে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সঙ্গে কোনও আপসে যেতে চায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। মামলার মাধ্যমেই সব অর্থ ফেরত আনতে চায় তারা। এ জন্য আগামী জুলাই মাসের ৬ তারিখের পর যে কোনও দিন আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থা’র দায়িত্বশীল সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, গত প্রায় এক বছর ধরে মামলায় যাওয়ার পরিবর্তে আরসিবিসি’র পক্ষ থেকে আপস প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এখন সেই অবস্থান পাল্টেছে আর্থিক খাতের সর্বোচ্চ এ সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যেহেতু রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা নেই, সেহেতু টাকা উদ্ধারে বাংলাদেশ কোনও অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপসে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা গ্রহণ করা হলেই আরসিবিসি সব টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হবে।’
এর আগে এপ্রিল মাসে আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় অর্থমন্ত্রী আবুল আবদুল মুহিতও ফিলিপাইনের আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জাগো বাংলা ২৪ কে জানান, ‘বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন দুই দেশই রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত সমস্যার সম্মানজনক সমাধান চাচ্ছে। ফিলিপাইন সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চায়, কিন্তু তারাও চয় নিজেদের দেশের কোনও প্রতিষ্ঠান যাতে কোনোভাবে অপরাধী সাব্যস্ত না হয়। বাংলাদেশের মতোই ফিলিপাইনও আশাবাদী, বাংলাদেশ তার সব টাকা ফেরত পাবে। সে দেশের সরকার এজন্যই বাংলাদেশকে সব ধরণের সহযোগিতা করছে। ফিলিপাইন বাংলাদেশের হয়ে সে দেশের আদালতে মামলা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে মামলা সংক্রান্ত কাজে যারা ফিলিপাইনে যাচ্ছেন, তাদের সব খরচও বহন করছে ওই দেশের সরকার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় আরসিবিসি’র জুপিটার স্ট্রিট শাখার সাবেক ম্যানেজার মায়া দেগুইতোর বিরুদ্ধে চলতি জুন মাসের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো ফিলিপাইনের আদালতে ক্রিমিনাল কেস শুরু হয়েছে। এখন সেটার ট্রায়াল চলছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘মায়া দেগুইতোর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস হওয়ায় বাংলাদেশ টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির পর পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে উঠে মায়ার বিরুদ্ধে।’
এছাড়া সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস ও আল জাজিরায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বাংলাদেশকে অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে উজ্জীবিত করছে। নিউইয়র্ক টাইমস ও আল জাজিরায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কেউ এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঘটনার ভিক্টিম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘এই রিজার্ভ চুরির পেছনে আর্ন্তজাতিক অপরাধীরা জড়িত। পৃথিবীর কয়েকটি দেশের বড় বড় গডফাদার ও জুয়াড়িরা জড়িত রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কোনও ব্যাক্তির সম্পৃক্ততা নেই। এ কারণে মামলা করার ক্ষেত্রে সব দিকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে (ফেড) রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। পাঁচটি সুইফট বার্তার মাধ্যমে চুরি হওয়া এই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত আসে। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বেশ কয়েকটি জুয়ার টেবিল ঘুরে হাতবদল হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি ডলার ফেরত এলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে এখনও তেমন কোনও অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জাগো বাংলা ২৪ কে আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করার প্রায় সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছে। মামলার অ্যাসেসমেন্ট ইতোমধ্যে করা হয়ে গেছে। মামলায় জেতার জন্য যে সব ডকুমেন্ট ও তথ্য দরকার তার সবই বাংলাদেশের আইনজীবীর হাতে রয়েছে। এমনকি মামলার প্রথম ধাপও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এখন রিকয়ারমেন্ট পেলেই ডকুমেন্টযুক্ত করে নিউ ইর্য়কের আদালতে মামলাটি সাবমিট হবে। আগামী জুলাই মাসে যদি কোনও কারণে সম্ভব না হয়, তাহলে আগামী আগস্টের মধ্যেই মামলা হবে। মামলার বাদী হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট কর্তৃপক্ষও থাকবে। যদিও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মামলা করার সময় আছে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর রাজী হাসান বলেন, ‘ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির কাছে আছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওই অর্থ নিয়ে ফিলিপাইনের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের একটি বাজেয়াপ্তকরণ মামলা দেশটির আদালতে চলমান। সোলায়ার নামের একটি ক্যাসিনোতে গিয়েছিল ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ওই অর্থ ফিলিপাইনের আদালত ফ্রিজ করে রেখেছে। এ বিষয়ে আরেকটি মামলা বিচারাধীন। আর কিম অং ক্যাসিনোতে যাওয়া ২ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে দেড় কোটি ফেরত আনা গেছে। তবে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ট্রেস করা যায়নি।’
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাইবার চুরির এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর, ফিলিপাইনের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান, একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল। ওই সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ঢাকায় মামলা করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি আড়াই বছরেও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি। পুরো বিশ্বে আলোচিত এই সাইবার চুরির পেছনে কারা ছিল, তা জানা যায়নি এখনও। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি অর্থমন্ত্রীর কাছে অনেক আগে প্রতিবেদন জমা দিলেও এ পর্যন্ত তা প্রকাশ করা হয়নি।