বোলিংয়ের রানআপ চাচার মতোই। অ্যাকশনেও তাই—ডান হাতে অফস্পিনের সঙ্গে চাচার মতো লেগ ব্রেক আর গুগলিও পারেন। আর উইকেট পাওয়ার পর উদ্যাপনেও কী দারুণ মিল! দুই হাত উঁচিয়ে স্মিত হাসি মুখে। সত্যিই রক্ত কথা বলে!
মোটা দাগে পার্থক্য শুধু চুল আর জার্সিতে। চাচার যৌবনে তাঁর রেশমি চুলের প্রেমে পড়েছেন অগণিত তরুণী। সংখ্যাটা এখনো কম না। কিন্তু ভাতিজার মাথায় চুলের উপস্থিতি বেশ কম। কপালের দুই পাশ দিয়ে টাক পড়ার সতর্ক সংকেত। আর জার্সি? চাচা গায়ে তুলেছেন পাকিস্তানের আর ভাতিজা উগান্ডার। বলা হচ্ছে শহীদ আফ্রিদি ও ইরফান আফ্রিদির কথা। প্রথমজন পাকিস্তানের জার্সিতে মাঠ মাতিয়ে এখন সাবেক। পরের জনের জন্ম পাকিস্তানে হলেও উগান্ডার অভিবাসন নিয়ে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগে খেলছেন। স্বপ্ন দেখেন, একদিন চাচার মতোই বিশ্বকাপে খেলবেন। এই দুই আফ্রিদি সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা।
২০১৩ সালে ২৮ বছর বয়সে উগান্ডায় পাড়ি জমান আফ্রিদি। আফ্রিকান দেশটির জার্সিতে তাঁর অভিষেক ঘটে তিন বছর পর ২০১৬ সালে, কাতারের বিপক্ষে। ইরফান এরপর থেকেই উগান্ডা ক্রিকেট দলে ভরসার অন্যতম নাম। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, উগান্ডায় পাড়ি জমানোর আগে ইরফানের কখনো ক্রিকেট বলে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধু কী তা–ই? ৩৩ বছর বয়সী এই স্পিনার পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটেও কখনো খেলেননি। খোলাসা করে বললে, একজন ক্রিকেটারের সেরা সময়ে—২৪ থেকে ২৮ বছর—ইরফান খুব কমই ক্রিকেট খেলেছেন।
কারণ, সেই বয়সে ইরফান ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবসা করতেন। আজও হয়তো দক্ষিণ কোরিয়াতেই থাকতেন যদি তাঁর চাচা মুশতাক আফ্রিদি—শহীদ আফ্রিদির ছোট ভাই—উগান্ডায় ব্যবসা করতে না চাইতেন। ইরফানের ভাষায়, ‘চাচা উগান্ডায় ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। আর তাই আমাকে উগান্ডা যেতে বলেন। তিনিই আমাকে উগান্ডা পাঠান। আমরা এখানে মোটরগাড়ি আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করি। হার্ড-বলে (ক্রিকেট বল) ক্রিকেট খেলাটাও শুরু হয় এখানে। তার আগে আমি কখনো হার্ড-বলে ক্রিকেট খেলিনি।’
পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাস সবচেয়ে সমৃদ্ধ বলেই ধরা হয়। যদিও ক্রিকেটবিশ্বে কেনিয়া এখন আক্ষেপের নাম। তবে উগান্ডার ক্রিকেটেরও ইতিহাস আছে। দেশটি থেকে দুজন ক্রিকেটার খেলেছেন প্রথম বিশ্বকাপে (১৯৭৫)। সেটি পূর্ব আফ্রিকার হয়ে (কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে গড়া দল)। ইরফান এসব জানতেন না কিংবা এসব নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহও ছিল না। উগান্ডার সাবেক পেসার আসাদু সেইগার সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেইগা একদিন নিজের ক্লাবে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলার দাওয়াত দেন ইরফানকে। সেটি ছিল ক্রিকেট বলের ম্যাচ। ‘ওখান থেকেই আমার ক্যারিয়ারের শুরু। সেইগা বলল, “তুমি তো খেলতে পার। তাহলে চেষ্টা করো না কেন?” এরপর খেলা শুরু করি এবং জাতীয় দলে সুযোগ পাই। সেইগা আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সে সব সময় বলত, “এটা করো, ওটা ওভাবে চেষ্টা করো। তোমার গায়ে উগান্ডার হলুদ জার্সি দেখতে চাই।”’ ক্রিকইনফোকে বলেন ইরফান।
সেইগা হয়তো ইরফানকে তুলে এনেছেন, কিন্তু বাকি পথটা ইরফান নিজেই হেঁটেছেন। গত মে মাসে মালয়েশিয়ায় ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ফোর টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১৫ উইকেট নেন ইরফান। এই সাফল্যের পেছনে ছিল তাঁর রহস্য-স্পিন। ইরফানের ভাষায়, ‘৮০ শতাংশ লেগ স্পিন, ১০ শতাংশ অফস্পিন আর ১০ শতাংশ ক্যারম বল।’ তাঁর স্পিন বৈচিত্র্যেই ওই টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে উগান্ডা। এরপর আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি আফ্রিকা অঞ্চলেও সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট নিয়ে দলকে পরবর্তী রাউন্ডে উন্নীত করেন ইরফান।
উগান্ডা জাতীয় দলের অধিনায়ক রজার মুকাসা তো ইরফানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁর ভাষায়, ‘ইরফান শুধু বোলিংয়ে উইকেট শিকার করা নয়, ব্যাটিংয়েও বল অনেক জোরে মারতে পারে।’ অর্থাৎ ইরফান তাঁর বিখ্যাত চাচা শহীদ আফ্রিদির পথেই হাঁটছেন। উগান্ডার হয়ে তাঁর ৭১ বলে ১০৮ আর ১৭ বলে ৫১ রানের মতো ম্যাচ জেতানো ইনিংস আছে। বেড়ে ওঠার সময় ক্রিকেটার চাচাকে ইরফান সেভাবে পাশে পাননি। ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার পথে নিজের চাচার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন ইরফান। সেটি ইউটিউব কিংবা টিভিতে চাচার খেলা দেখে। মে-তে ভানুয়াতুর বিপক্ষে ১৭ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলার পর চাচার কাছ থেকে অভিনন্দনসূচক খুদে বার্তা পেয়েছিলেন ইরফান।
ওমানে আজ থেকে শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন থ্রি টুর্নামেন্ট। এই প্রতিযোগিতায় উগান্ডার হয়ে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে ইরফান আফ্রিদিকে। দেশটির হলুদ জার্সি পরে এই আফ্রিদি যখন মাঠে নামবেন, তখন অনেকেই হয়তো তাঁর মধ্যে ‘সিনিয়র’ আফ্রিদিকে খুঁজবেন। না পেলেও ক্ষতি নেই। ইরফান তো তাঁর চাচারই ‘ভাতিজা’ আফ্রিদি!