মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় বান্দরবান সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টারশেল শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া এলাকার সীমান্তে পড়ে। বিস্ফোরণে একজন নিহত ও পাঁচ জন আহত হন। এই ঘটনার পর থেকে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে গতকাল শনিবার সকাল ৭টার দিকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী আবারও মিয়ানমান সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এই ঘটনায় সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন পরিদর্শন করেও এর সত্যতা মিলেছে। তবে দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার তথ্য তাদের কাছে নেই। সবাইকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে অবৈধ কাউকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গোলা আসা বন্ধ না হলে বিষয়টি জাতিসংঘে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, স্পষ্ট কথা, আমরা এটার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। আমাদের পক্ষ থেকে না হলে জাতিসংঘের কাছে তুলব, সব কিছু করব।’
এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুপুরে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ার পর ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। তারপর আরেক দফায় তাকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটা উসকানিমূলক না। এটা স্ট্রে (আকস্মিক চলে এসেছে)।’ এরপর গত শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু ও কোণাপাড়া সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পের ভেতর গোলা পড়ে একজন নিহত হয়। এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপি শনিবারই সংবাদ সম্মেলন করে। সীমান্তবর্তী নো-ম্যান্স ল্যান্ডে এখনো কিছু কিছু মানুষ অবস্থান করছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘এটা পাতানো যুদ্ধ। রাখাইনে এখনো দুই লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাদের বিতাড়িত করতেই এই যুদ্ধ নাটক।’
বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে কাউকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেব না। যেকোন পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। বিজিবি সতর্কবস্থায় আছে। স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তায় আমরা নিয়োজিত। তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তবে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।’
বিষয়টি নিশ্চিত করে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা বিবেচনা নিয়ে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রটি সরিয়ে পাশ্ববর্তী কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরিত হয়ে এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৫ জন। তার আগে সীমান্তের জিরো লাইনে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে উনুসাই তংচঙ্গ্যা নামে এক বাংলাদেশির পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়রা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনাপাড়া নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রের পাশে কোনাকখাল এলাকায় ফের তিনটি মর্টারশেল এর গোলা এসে পড়েছিল শুক্রবার রাত আটটায়। সীমান্তের এপারে এসে পড়েছিল ভারী অস্ত্রের গুলিও। ঐ রাতে সীমান্ত এলাকার মিয়ামনারের আকাশে বিমান ও হেলিকপ্টার টহল দিতে দেখা গেছে। মর্টারশেল বিস্ফোরিত হয়ে রোহিঙ্গা শিশুসহ চার জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে গুরুতর মো. ইকবাল নামে এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। আহতদের অবস্থাও গুরুতর। তারা কক্সবাজার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের দাবি, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমার সরকার বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ বিমান, ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে গোলাগুলি এবং গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। শুক্রবার তৃতীয় দফায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাতের মর্টারশেলের তিনটি গোলা এসে পড়েছিল তুমব্রু সীমান্তে। তার আগে যুদ্ধ বিমান এবং মর্টারশেল এর ছোড়া গোলা আরও দু’বার এসে পড়েছিল একই সীমান্তের জনবসতি এলাকায়। ভারী অস্ত্রশস্ত্রের গুলিও বিভিন্ন সময়ে উড়ে এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমানায়। এ কারণে ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম-তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, রেজু-আমতলী সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সীমান্তের বাসিন্দাদের অনেকেই পাশের এলাকায় আত্মীয় স্বজনদের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জিরো লাইনের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুক্রবারের ঘটনার পর আতঙ্কে বন্ধ করে দেওয়া হয় তুমব্রু বাজারের সকল দোকানপাট।
তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহজাহান বলেন, সীমান্তে অব্যাহত গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম ইউনিয়নের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্থানীয়রা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির জলপাইতলী, গর্জনবনিয়া, বরইতলী, বাইশপারি, তুমব্রু, পাত্তার ঝিরি ও ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দরা বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সালমা ফেরদৌস জানান, সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর সীমান্তে বিজিবির টহল ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি। সীমান্তের আশেপাশে কাউকে যেতে দিচ্ছে না বিজিবি।
সীমান্ত এলাকার জিরো লাইনের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সর্দার দিল মোহাম্মদ জানান, আগে দিনের বেলায় গোলাগুলি হলেও বর্তমানে রাতেই সংঘর্ষ ও গোলাগুলি বেশি হচ্ছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া ১২টি মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মি মাঝে চলমান সংঘাতের বাহানায় মিয়ানমারে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশ বা অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য করার অপচেষ্টা করছে মিয়ানমার, এমন অভিযোগ সে দেশে বসবাসকারি রোহিঙ্গাদের। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি এলাকায় রোহিঙ্গাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সেদেশে থাকা রোহিঙ্গারা। শুধু সেনাবাহিনী নয়, আরাকান আর্মির সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে চাপ প্রয়োগ করছে। দুই লাখ রোহিঙ্গা যে এলাকা অবস্থান করছে সেটি ঘিরে রেখেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের মংডুর তুমব্রু এলাকার রোহিঙ্গা নুরুল বশর জানান, মিয়ানমার ও আরকান আর্মির মধ্যেই চলমান সংঘাতের জেরে এদেশে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বার বার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করতেছেন তারা। এ সংঘাত চলতে থাকলে রোহিঙ্গারা আরকান রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। তাদের আশঙ্কা গোলাগুলির বাহানায় ২০১৭ সালের মত রোহিঙ্গাদের ওপরে আবারও গণহত্যা চালাতে পারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের সাথে রাখাইন যুবকরাও হামলায় যোগ দেয়। যারা আরাকান আর্মির সক্রিয় সদস্য।
এ অবস্থায় নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢোকার আশঙ্কা করা হলেও সরকার কঠোর ভাবে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। কঠোর অবস্থানে রয়েছে সীমান্ত ও নৌপথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তথ্য এসেছে, এরমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।