দুই বছর পার হলেও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। হামলায় সরাসরি জড়িত সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হলেও পুলিশ ছুটছে এই হামলায় নেপথ্যের ব্যক্তিদের সন্ধানে। শোলাকিয়ায় হামলা মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুর রহমান বলেন, ‘এখনও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তাই মামলার অভিযোগপত্র দিতে আরও সময় লাগবে। তবে তদন্তের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। মামলার তদন্তে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কাজে লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৬ সালে ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার অন্যতম হোতা ছিল জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজিব গান্ধী (৩২)। গত ২৯ মে তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয় কিশোরগঞ্জ পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে সে। পুলিশের কাছে হামলার অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা এবং হামলার নেপথ্যে আরও কারা ছিল, তাদের নাম প্রকাশ করেছে রাজিব। জিজ্ঞাসাবাদে গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া হামলায় রাজিব গান্ধী নিজের জড়িত থাকাসহ আরও অনেকের নাম বলেছে। রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে সে।’ তবে জিজ্ঞাসাবাদে কাদের নাম বা কত জনের নাম এসেছে, তা জানাননি তদন্ত কর্মকর্তা।.
আরিফুর রহমান বলেন, ‘এ মামলায় বর্তমানে জাহিদুল হকসহ পাঁচজন জেলহাজতে রয়েছে। বাকি চারজন হলো— জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, জেএমবি সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, আনোয়ার হোসেন ও আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলাসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলার ঘটনায় এ চারজন আটক ছিল। পরে তাদেরকে শোলাকিয়া জঙ্গি হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ’
কিশোরগঞ্জরে পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং সেলে মামলাটির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’
সূত্র জানায়, রংপুরে জাপানি নাগরিক ওসি কুনিও ও ধর্মান্তরিত রহমত আলী, পঞ্চগড়ের যজ্ঞেশ্বর পুরোহিত, কুড়িগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী, গাইবান্ধার তরুন দত্ত, দেবেশ ও ফজলে রাব্বী, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিল, পাবনার নিত্যানন্দ পান্ডব, নাটোরের সুনীল গোমেজ, কুষ্টিয়ার ডা. সানাউল, রাজশাহীর প্রফেসর রেজাউল ও ঢাকার সিজার তাবেলা হত্যাকাণ্ডসহ নব্য জেএমবির সদস্যরা সারাদেশে আরও ২৪ জনকে হত্যা করে। ওইসব হত্যার ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে থেকে সাহসী সদস্যদের হলি আর্টিজান এবং শোলাকিয়ায় হামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।.
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শোলাকিয়া হামলার মূল পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী। তার সঙ্গে তামিম চৌধুরী, মারজান, সারোয়ান জাহান মানিক ও মেজর জাহিদ মিলে হামলার ছক তৈরি করে। এরা সবাই নব্য জেএমবির সদস্য। তদন্ত কর্মকর্তার দাবি— হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিপুল সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটানো। শোলাকিয়া জামাতের ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাউসদকেও হত্যা করতে চেয়েছিল তারা।
সূত্র আরও জানায়, হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার পরিকল্পনা একসঙ্গেই করা হয়। এ নিয়ে জঙ্গিরা ঢাকায় দু’দফা বৈঠক করে। রাজীব গান্ধী হামলাকারীদের মধ্যে খায়রুল ইসলাম পায়েল বাধন, শরিফুল ইসলাম ডন, রোহান ইমতিয়াজ স্বপন ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলকে দুটি হামলার দায়িত্ব দেয়।
পরবর্তী সময়ে শোলাকিয়া হামলায় অংশ নেওয়া তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে, মেজর জাহিদ ঢাকার রূপনগরে, আকাশ গাজীপুরের পাতারটেকে ও শরিফুল ইসলাম ডন পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যায়।
এছাড়া, আবির রহমান শোলাকিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। সে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ত্রিবিদ্যা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। আবির ঢাকায় নর্থ- সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ছাত্র ছিল। এদিন পুলিশের গুলিতে আহত হয় আরেক জঙ্গি শফিউল ইসলাম (ডন)। তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট র্যা বের একটি দল ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ নিয়ে আসার পথে নান্দাইলে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র্যা বের ‘বন্দুকযুদ্ধে’র সময় শফিউল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট এলাকার আব্দুল হাইয়ের ছেলে। পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে র্যা বের দলটি সেসময় তাকে কিশোরগঞ্জে নিয়ে আসছিল।
শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় শফিউল ইসলাম (ডন), জাহিদুল হক তানিম এবং অজ্ঞাতনামা আরও কিছু আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১০ জুলাই পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শামসুদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৭ জুলাই শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় পুলিশ সদস্য আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম নিহত হন। এছাড়া দু’পক্ষের গোলাগুলির সময় নিহত হন শোলাকিয়া এলাকার ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে এক নারী।